Skip to content

৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফর্সা ত্বক ইজ দ্য বেস্ট’

সম্ভবত বাংলাদেশর মানুষ সব চেয়ে বেশি বর্ণবাদ-বিরোধী। কারণ, স্কিন টোন যা-ই হোক, বাংলাদেশে সবার ফাউন্ডেশন এর শেড হয় ভ্যানিলার মতো সাদা। কারণ, 
‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফর্সা গায়ের রং ইজ দ্যা বেস্ট।’ 

 

কী অদ্ভুত একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ আমার!  

 

এ-ছাড়া, ফর্সা হওয়া মানে, জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান পেয়ে ফেলা। প্রথমত, বিয়ে। আমরা জানি,  বিয়ে নারীজীবনের সমস্ত সমস্যার তথাকথিত সমাধান হিসেবে সর্বোপরি স্বীকৃত। 

 

অতএব, যে নারীর গায়ের রং ফর্সা না হয়ে কালো হয়,  সে নারীর জীবনে আর কিছুই হবে না বলে গণ্য করে এই সমাজ। কিন্তু এই মুশকিল আসানের প্রজন্মে কেউ কেন সমস্যা নিয়ে বসে থাকবে? সমাধান আছে: 

 

একটা মেয়ে কালো হলেও সে যদি মেকাপ করে নিজেকে পুঙ্খাণুপুঙ্খ সাদা রঙের ফাউন্ডেশন দিয়ে ঢেকে দিতে পারে,  তাহলে তাকে যোগ্য পাত্রী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। 
 
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন ই-কমার্সের একটা মোক্ষম ভূমি হিসেবে পরিচিত।  এখানে বিভিন্ন বিদেশি পণ্য নিয়ে এসে অনলাইনে বিক্রি করেন অনেকে। তারা তাদের নতুন নতুন আবিষ্কারের কিছু স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টও নিয়ে আসেন৷ যেগুলোকে তারা ব্র্যান্ডিং করেন লাইভে এসে। এবং দাবি করেন, এই ক্রিম ব্যবহার করলে রাতের অন্ধকারে চাঁদের মতো রশ্মি ছড়াবে তাদের মুখ। এবং খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে এই কথাগুলো তারা বলেন।

 

সাথে সাথে এই ধরনের রং ফর্সাকারী ক্রিম এবং স্কিন কেয়ার করার পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে যে ব্রান্ডিং করেন, সেটা অসম্ভব রকমের বর্ণবাদী আর ‘কালো মানে অসুন্দর ট্যাগলাইন’ জাতীয় হয়।  

 

‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফর্সা ত্বক ইজ দ্য বেস্ট’

 

কিন্তু রং ফর্সাকারী ক্রিম যে ত্বকের জন্য কতটা ক্ষতিকর, সেটা নিয়ে তারা কখনো কোনো কথা বলেন না।

 

অনেক মানুষের ভয়াবহ রকম চর্মজনিত অনেক সমস্যাও হয়।  ডার্মাটলোজিস্টরাও এই সব ক্রিম সম্পর্কে ভয়ংকর নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে বড়সড় রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকির শংকাও রয়েছে বলে তারা জানান।

 

কিন্তু এই সব স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করেও এই রং ফর্সাকারী ক্রিমের মার্কেটপ্লেস অনেক বেশি  
স্বনামধন্য। কারণ, লোকে মনে করে:

‘যায় যদি যাক প্রাণ, 
গায়ের চামড়া সাদা না হলে 
ভেস্তে যাবে তার মান।’ 

 

এ-দেশে গায়ের রং দিয়ে মানুষকে যোগ্য-অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। একটা সময় ছিল, যখন টিভি ও সিনেমা অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে গায়ের রং ফর্সা না হলে তারা নায়িকা হতে পারতেন না। 

 

‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফর্সা ত্বক ইজ দ্য বেস্ট’

 

অভিনয় কতটুকু পারেন, আর কতটুকু পারেন না, সেটা তেমন মুখ্য বিষয় ছিল না। এখন যদিও সময় বদলেছে। অন্যান্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকাদের গায়ের রং দিয়ে মাথাব্যথা কম হতেই দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সিনেমার ক্ষেত্রে চামড়ার রং নিয়ে এখনো অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত নন।

 

এ-ছাড়া, সিনেমা জগতে গায়ের কালো রং ইচ্ছা করে আরো কালো বানিয়ে তাদেরকে কমেডি ক্যারেক্টার এবং খলনায়ক/নায়িকা চরিত্র দেয়া হতো, যা স্পষ্টত  স্কিন কালারকে ছোট করে দেখানোর সামিল। 

 

গায়ের রঙের ওপর নির্ভর করে, একজন নারী তার পরিবারের জন্য কতটা লক্ষ্মী বা অলক্ষ্মী।  অনেকে তার পরিবারে কালো চামড়ার গায়ের রঙের মেয়েকে অপয়া বলে সম্বোধন করেন। 

 

ছোটবেলা থেলে স্কুল-কলেজে অনেকে বুলিংয়ের শিকারও হয় সে। কারণ, তার গায়ের রং কালো। ফলে বড় হওয়ার পর কালো মেয়েদের মনোজগতে নিজেদের নিয়ে দিুশ্চিন্তা তৈরি হয়। নিজেকে আস্তে আস্তে গুঁটিয়ে নিতে শুরু করে তারা। আর নিজেকে ফর্সা বানানোর জন্য নানা রকমের ক্ষতিকর রংফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করতে শুরু করে। 

 

মেকআপ করলে নিজের জন্য সব চেয়ে উজ্জ্বল রঙের সাদা শেডের ফাউন্ডেশন বাজার থেকে কিনে আনে।  মেকআপ করলে অন্তত যেন তাকে কালো না লাগে। মোবাইল ফোনে সেল্ফি তোলার সময় মুখ ফর্সা লাগে, এমন কিছু ফিল্টার ব্যবহার করে থাকে, যে ফিল্টার ব্যবহার করলে তাদের দেখতে ফর্সা বলে মনে হয়। কারণ, তারা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছে, গায়ের কালো রং কোনো ভালো রং না। 

 

ব্যক্তিগত কিছু জল্পনা ছাড়াও বিশ্বব্যাপী গায়ের কালো  রং নিয়ে বড় পরিসরেও একটা প্রহসন করতে দেখা যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত ত্বক ফর্সাকারী ব্র্যান্ড বিরাট সময় ধরে রং ফর্সাকরা নিয়ে ব্যাপক হারে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। 

 

এই প্রোডাক্টের নাম থেকে শুরু করে তার কাজকাম প্রচার হচ্ছে। হালে তরুণ-তরুণীকে উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ এবং প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে হানিভাঙা মোষের মতো লোকে সেগুলো আপন করেও নিয়েছে। 

 

যদিও পরবর্তী সময়ে, তাদের ব্র্যান্ডের নাম তারা পরিবর্তন করেছে। কারণ, একসময় লোকের টনক নড়েছে যে, এই ব্র্যান্ডের নাম মূলত রেসিজম বা বর্ণবাদকে প্রোমট করছে। এবং অনেকেই এই ত্বকফর্সাকারী ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনা তুলে ধরেছেন।  

 

এ-ছাড়া, দেশের কিছু জনপ্রিয় সংবাদপত্র, গায়ের রং যেমনই হোক ‘তবুও’ সেটা সুন্দর বলে রেসিজমকে কিঞ্চিৎ উৎসাহিত করেছে। 

 

হতে পারে এটা বাংলা ব্যকরণে অব্যয়ীভাব প্রকাশে সামান্য অনীহা।  কিংবা কোনো লেখার ভাষা কী হবে, সে বিষয়ে অপারগতা। সে-রকম  হলে এই বিষয়ে নিতান্তই দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করার নেই। 

কিন্তু যদিও, ব্যকরণজনিত কারো ভুল হলে সেখানে সহমর্মিতা দেখানো একটি প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কাজ। তবু, কাঁধে হাত রেখে এটা বলতে পারি যে, 

‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমার-আমার 
নতুন অব্যয়ের সুরে ।’ 

গায়ের চামড়া নিয়ে ২০২২ সালে এসেও আমাদের মধ্যে বর্ণবাদ নির্মূল করা কঠিন।  কারণ, গায়ের রং দিয়ে মানুষ বিবেচনা করার যে চল রয়েছে,  সেটা ছোটবেলা থেকে মগজে পেরেকের মতো ঠুকে দেয়া একটি মতবাদ।

 

‘ইস্ট অর ওয়েস্ট, ফর্সা ত্বক ইজ দ্য বেস্ট’

 

অতএব, এই ধ্যান-ধারণা থেকে উঠে আসা কঠিন। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে। মানুষের নিজের জীবনে এতই কাজের অভাব যে, আরেকজনের গায়ের রং কী, সেটা নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে। এবং প্রতিনিয়তই সামাজিক ও পারিবারিকভাবে একটা চাপ সৃষ্টি করছে একজন  নারীর পারিপার্শ্বিকতায়।  

 

কিন্তু গায়ের রঙের ধারণাটি তো সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক। মেলালনিন নামক হরমোনের প্রভাবে গায়ের রঙে ফারাক আসে। এই ব্যাপারে কারো কিছু বলা মানে একটি প্রকৃতি-বিরোধী বক্তব্য, যা একে তো হাস্যকর আর দ্বিতীয়ত, বিরক্তিকর রকমের অশিক্ষা। 

 

আমরা অনেক দিক দিয়েই হয়তো আধুনিকতার অনেক সুযোগ নিচ্ছি। নিজ নিজ পরিবার ও এলাকা ভেদে হয়তো বেঁচে থাকার নতুন নতুন পন্থা অনুসরণ করছি। কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা কতটুকু সভ্য হতে পেরেছি? কারো গায়ের রং এবং পোশাক নিয়ে বিরূপ মন্তব্য দেয়াটা যে অভদ্রতার শিখরে আর এই মন্তব্যের কোনো ফলাফল যে আদৌ নেই। সেটা আমরা কবে বুঝব? 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ