নারীশিক্ষা: শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজ ও পরিবারকেও সচেতন হতে হবে
কথায় বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একটি দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত বেশ বৈষম্য থাকে । শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা আলাদা দেখা যায়, লিঙ্গভেদে।
আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেই যদি ধরি, পরিবার বা অভিভাবকরা ছেলেসন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিধা পোষণ না করলেও মেয়েসন্তানের বেলায় দশবার ভাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শুরুর দিকে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই স্কুলে ভর্তি করা হলেও ধীরে-ধীরে ঝরে যায় মেয়েরা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক প্রতিটি পর্যায়ে একটি বিশাল অঙ্কের নারী শিক্ষার্থী ঝরে যেতে থাকে।
বাবার আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণিতেই শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয় নাসিমা বেগমকে। দুই ভাই, দুই বোনের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছে তার দুই ভাই। অন্য দিকে, পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি তারা দুই বোন শিকার হন বাল্যবিয়েরও। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে ছেলেসন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন তার মা-বাবা।
নাসিমা বেগমদের দুই বোনের কেউই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেন। কারণ, তাদের আর্থিক অবস্থা ও মা-বাবার স্বল্প শিক্ষার কারণে। তবে এ দৃশ্যের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিহা আক্তারের। তার মা-বাবা দুজনই পেশায় শিক্ষক। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। আর্থিক দিক থেকেও বেশ সচ্ছল।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ছেলেসন্তানকে আরো উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি করালেন দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্য দিকে, মেয়ের ভালো ফল ও ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে ভর্তি করান স্থানীয় একটি কলেজে। তাঁদের মতো শিক্ষিত মা-বাবাও ছক কষেছেন মেয়ের শিক্ষা নিয়ে লাভ-ক্ষতির।
এমন দৃশ্য রয়েছে আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবারে। বাল্যবিয়ে, পারিবারিক ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীশিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতি যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে । সরকার উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বইপ্রদানসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীশিক্ষায় জোর দিতে চাইলেও সমাজ যেন, কোনোভাবেই মানতে নারাজ।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো প্রগতিশীল নারীদের পথ আটকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, মেয়েদের পড়ালেখা করে কী হবে? তাদের মতে মেয়েদের জন্ম হয়েছে সংসার সামলানোর জন্য, বাইরের পৃথিবীতে একা চলার অধিকার নারীর নেই।
গত কয়েক দশকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, তার খুব কম অংশই সমাজের চোখে পরেছে। তারা নারী-শিক্ষার বিপরীতে কোনো যুক্তি খুঁজে বের করতে মরিয়া। দেশের উন্নয়ন কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে নারীকে সমানভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে।
পুরুষের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীশিক্ষার এমন বেহাল নারী-শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তবে এই দায় শুধু রাষ্ট্রের নয়, এ দায় নিতে হবে সমাজ ও পরিবারকেও। শুধু রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপে নারীশিক্ষার খুব বেশি উন্নতি দৃশ্যমান হবে না, যদি সমাজ ও পরিবার একযোগে সচেতন না হয়।