যৌন শিক্ষা নিয়ে কেন এতো সংকোচ?
'যৌন' শব্দটির সাথেই যেনো আমাদের সমাজের চিরাচরিত এক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সাধারণত ১০-১১ বছর বয়সের পর থেকেই যৌন-স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়া উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অল্প বয়স থেকে শিশুদের 'যৌন শিক্ষা' দেয়া হলেও বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলাকেও একধরণের অন্যায়ই ধরা হয়।
একটু যেনে নেয়া যাক 'যৌন শিক্ষা ' বিষয়টি আসলে কি? যৌনশিক্ষায় মূলত মানব যৌনতা, যার মাধ্যমে মানসিক সম্পর্ক এবং দায়িত্ববোধ, যৌনাচার, যৌন প্রজনন, সম্মতির বয়স, প্রজনন স্বাস্থ্য, প্রজনন অধিকার, নিরাপদ যৌনতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং যৌন নিবিড়তা সহ মানব যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি নির্দেশ করা হয়। যৌন শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব, যৌন ক্রিয়াকলাপ, সঠিক বয়স, উর্বরতা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, যৌন পরিহার ইত্যাদি সম্পর্কে শেখায়।
পিরিয়ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার কোনো সুযোগ না থাকায় বিভিন্ন সময় শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতায়ও ভোগেন তারা। এছাড়া চারপাশের মানুষের এতো সংকোচ দেখে তারা পিরিয়ড চলাকালীন সময় নিজেকে একঘরে করে ফেলেন এবং বিষণ্ণতায়ও ভুগেন৷
বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই কিছু পরিবর্তন আসলেও আমাদের দেশে বিশেষ করে মেয়েলি ব্যাপারগুলোকে একধরনের গোপন বিষয় হিসেবেই দেখা হয়। বাড়িতে সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডায় অনেক বিষয় নিয়ে গল্প হলেও ভুলেও এসংক্রান্ত কোনো আলোচনা তোলা হয় না। যৌনতা নিয়ে কথা বলাকে একধরনের অন্যায়ই মনে হয়।
তবে উপায়?
আমাদের দেশে যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে সকলেরই সংকোচ। 'যৌন' শব্দটি শুনলেও মাথা নিচু করে নেয় সমাজের বেশিরভাগ মানুষ। তবে এবার মাথা উঁচু করার পালা। তবেই কাটবে সংকোচ। এ দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বোপরি সমাজকেও।
শুরুটা হোক পরিবার থেকেই-
হয়তোবা আপনি ভাবছেন, সন্তানের সাথে যৌন শিক্ষা নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। এটি একটি অত্যন্ত গোপন বিষয়। আপনি আচার-আচরণেও এমনি ভাব প্রকাশ করছেন। এতে করে আপনার সন্তান বরং আতঙ্কিত হচ্ছে। কোনো কোনো সময় অপরাধ বোধ কাজ করছে এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ভুল দিকে পা বাড়াচ্ছে। যৌন শিক্ষার শুরুটা হওয়া উচিত পরিবার থেকেই। খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত যৌন শিক্ষা নিয়ে। যৌন সম্পর্ক কী? কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অবশ্যই যৌনরোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করা উচিত।
এসব বিষয়ে অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় ধর্ষণের মতো অপরাধের। নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে দেয়া উচিত পরিবার থেকেই। যাতে করে তারা বুঝতে পারে কোনটি ভালো স্পর্শ, কোনটি খারাপ স্পর্শ। এছাড়াও যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের সংজ্ঞা আসলে কি? সে বিষয়েও তাদের শিক্ষা দেয়া উচিত। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই যদি যৌন শিক্ষার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যায় তবে কিশোর-কিশোরীদের অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
বাড়িতেই যৌন শিক্ষার গোড়াপত্তন করতে হলে সবথেকে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে মা – বাবার। আর সেজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সন্তানের সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরি করা৷ যাতে সন্তান নিঃসংকোচে যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে৷ অবশ্যই তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে হবে।
এগিয়ে আসুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজ-
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলে-মেয়ে সবারই যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে জানা দরকার৷ বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হলেও আমাদের দেশে এখনও তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দেশেও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণীতে যৌন শিক্ষা বিষয়ক অধ্যায় থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যায়টা এড়িয়ে যান শিক্ষকরা।
রাজধানীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান মীম। তার বিদ্যালয়ে প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি কিভাবে পড়ানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষক অন্য সব অধ্যায় ঠিকভাবে পড়িয়েছে। তবে এই অধ্যায়ে এসে বলেছেন, 'এখানে পড়ানোর তেমন কিছু নেই, তোমরা বাড়িতে পড়ে নিবে।' এই দৃশ্য দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে।
পরিবার থেকে এসব বিষয়ে ধারণা দেয়া হলেও তাদের এ বিষয়ে বিস্তর জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষকদেরই। কিছু কিছু সচেতন পরিবার থাকলেও আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামের দিকে শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে খুব বেশি সহায়তা পাননা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে 'যৌন শিক্ষা ' আসলে কি? কেন আমাদের জন্য এ বিষয়টি জানা জরুরী। সর্বোপরি আমাদের সকলকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে সামাজিক ভাবে। যাতে সমাজে 'যৌন শিক্ষা' সংক্রান্ত যত ট্যাবু আছে তা আমরা সহজেই ভাঙতে পারি৷
সর্বোপরি 'যৌন শিক্ষা' নিয়ে সংকোচ কাটাতে যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত৷ এতে করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে৷ শুধু শিক্ষা, আধুনিকতা, ফ্যাশন আর পোশাকের দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে হবে না তার সাথে তাল মিলিয়ে যৌন শিক্ষার দিক দিয়েও এগিয়ে যেতে হবে। তাই এখনি সময় এ সংকোচ ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার।