নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন যারা
একটা সময় ছিল যখন নারী চার-দেয়ালে বন্দি ছিল। নারী শিক্ষা কিংবা নারীর অধিকার আদায়ে ছিল অনিশ্চয়তা। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া মানেই হলো ঘরের কাজ করা। ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় দিক দিয়েই নারীদের ঘরে আটকে রাখা হতো। বর্তমানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই সময়গুলো কাটিয়ে উঠে নারীরা আজ শিক্ষিত হচ্ছে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠছেন। নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আদায়ে অন্যতম ভূমিকা রাখা নারীরা হলেন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ আরও অনেকে। নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় যারা ছিলেন তাদের সম্পর্কে আজ আমরা জানবো।
বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের অন্যতম একজন অগ্রদূত। যিনি নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার আদায়ে আজীবন কাজ করে গেছেন। নারীদের টেনে এনেছিলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে, অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বের করে নারী শিক্ষায় রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষায় রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে কিন্তু তারপরও তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিলেন। নারীদের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় থেকে বের করে আশার আলো দেখিয়েছিলেন মহীয়সী এই নারী। নারী শিক্ষা ও নারী অধিকার আদায়ের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর রচিত 'সুলতানাস ড্রিমস' বইটি পরবর্তীতে 'সুলতানার স্বপ্ন' নামে রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থগুলো হলো- 'অবরোধবাসিনী', 'মতিচূর', 'পদ্মরাগ'।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি জরিপের আয়োজন করে। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। সেই শ্রেষ্ঠ কুড়ি জনের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন আমাদের বেগম রোকেয়া। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে বেরিয়ে নারী শিক্ষায় অগ্রসর হওয়া এবং নারীর স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠা এবং সর্বোপরি বাবা কিংবা স্বামীর পরিচয়ে নয় নারীর নিজের পরিচয়ে সমাজে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে বেগম রোকেয়া সারাজীবন বাংলার নারীদের অন্তরে বিরাজ করবেন এবং নারী শিক্ষার প্রসারে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হবে।
সুফিয়া কামাল
নারী জাগরণের অন্যতম একজন পথিকৃৎ হলেন সুফিয়া কামাল। যিনি ছিলেন বাংলা ভাষার একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিপক্ষে একজন সোচ্চার সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন সুফিয়া কামাল। তাঁর জন্মের সময়ে নারী শিক্ষা তো দূরে নারীর বাইরে বের হওয়া ছিল মুস্কিল। তাঁর পরিবারও সমাজের এই নিয়মের বাইরে ছিল না। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও সকল বাঁধা অতিক্রম করে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
সুফিয়া কামাল তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সাহিত্যে তার সৃজনশীলতা ছিল অবিস্মরণীয়। শিশুতোষ রচনা সহ দেশ, প্রকৃতি, গণতন্ত্র, সমাজ সংস্কার এবং নারী মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার লেখা আজও প্রতিটি পাঠককে অনুপ্রাণিত করে। কবি সুফিয়া কামাল নারীবাদী নেত্রী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত। তিনি ১৯৫৬ সালে 'কচিকাঁচার মেলা' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬১ সালে ছায়ানটের সভাপতি, ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের সময় মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি, ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠন ও ঐ সময় অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের নেতৃত্ব দেন। বাঙালির হৃদয়ে সুফিয়া কামাল আজও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন ও থাকবেন।
নূরজাহান বেগম
বাংলাদেশের নারীদের সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে সম্পাদনা সবকিছুর যাত্রাই শুরু করেছিল নূরজাহান বেগমের হাত ধরে। তিনি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকা প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক ছিল। নূরজাহান বেগম সর্বস্তরের ও সর্ব-মহলের নারীদের কথা তুলে এনেছিলেন তাঁর সম্পাদিত বেগম পত্রিকার মধ্য দিয়ে। এসব লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে নারীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠেছিল এবং বাংলাদেশে ধীরে ধীরে নারী স্বাধীনতার পথ বিস্তৃত হয়েছিল। সেইসাথে তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের নারীদের সাংবাদিকতায় আসার সুযোগ হয়েছিল।
নারী জাগরণ, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করা ও নতুন লেখক তৈরি করাই নূরজাহান বেগমের মূল লক্ষ্য ছিল। বেগম পত্রিকায় নারী জাগরণ, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা সব বিষয়গুলো নূরজাহান বেগম নিজের সম্পাদনায় তুলে এনেছিলেন। নারী প্রগতি, নারী শিক্ষা অর্থাৎ প্রকৃত নারী অর্থেই "বেগম" ছিল অনন্য এক মাধ্যম। যেখানে কুসংস্কার বিলোপের কথা থেকে শুরু করে, গ্রাম-গঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠিও উঠে এসেছিল। নুরজাহান বেগম জীবনের পুরোটা সময় নারীদের নিয়েই কাজ করে গেছেন।
নীলিমা ইব্রাহিম
নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী জাগরণে বাংলার নারীরা বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। তাদেরই একজন হলো নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং সমাজকর্মী। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি' বইয়ের মাধ্যমে নারীর সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন ড. নীলিমা ইব্রাহিম। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনেও তাঁর অবদান রয়েছে। মহীয়সী এই নারী শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি- সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন একজন অকুতোভয় নারী, যিনি কখনও সত্যের সাথে আপোষ করেন নি। নারীর কথা তুলে ধরার চেষ্টা বরাবরই করেছেন। সবসময় নারীর পাশে দাঁড়িয়ে নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে নীলিমা ইব্রাহিম প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সময়ের অনেক ছাত্রনেতাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ দায়িত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন এবং সমাজকল্যাণমূলক ও নারীর উন্নয়ন বিষয়ক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত ছিলেন।
১৯৪৫ সালে নীলিমা প্রথম নারী হিসেবে বিহারীলাল মিত্র বৃত্তি লাভ করেন। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য নানান পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এগুলো হলো- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতি পদক (১৯৯০), অনন্যা সাহিত্য পদক (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) এবং একুশে পদক (২০০০)।