Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘তোমার ভুবনে মা গো এত পাপ’

কিছু কিছু ঘটনা মাথার ভেতরে ভাঙা রেকর্ডের মতো সারা দিন ধরে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিছু কিছু ঘটনার হিসাব মেলাতে পারি না কিছুতেই। গত এক সপ্তাহে এমন কিছু ঘটনা মিডিয়ায় দেখেছি, যেগুলোর অবস্থা কেঁচো খুঁড়তে কেউটে আবিষ্কারের মতো।

 

রাজধানীর বসিলার লাউতলা খালে গত রবি ও সোমবার উচ্ছেদ অভিযানে নামেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেখানে খালের জায়গা ভরাট করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। আবার ২৬ জানুয়ারি ডেইলি স্টারের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ভুলবশত’ তুরাগ নদের একটি অংশ ভরাট করে ফেলেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ! বলা হয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি না নিয়ে নদীর অংশ ভরাট করে ঢাকা-আশুলিয়া রাস্তার কাজ করছে সেতু কর্তৃপক্ষের চীনা ঠিকাদার। আপাতত কাজ বন্ধ আছে। সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, অনুমতি নিয়ে প্রয়োজনে আবার ভরাট করা জমিতে কাজ শুরু করা হবে!

 

কী অদ্ভুত! ঢাকার চারপাশের প্রত্যেকটি নদীর যেখানে দুরবস্থা, সেখানে তুরাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নদ সরকারি সংস্থা ভরাট করে কীভাবে? রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, নদী কমিশন কি মেঘনা, ফুলদি, কুহেলিয়া নদীর মতো এখানেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করবে? এদিকে ২০০৯ সালের ২৪ জুন মহামান্য হাইকোর্ট সুস্পষ্টভাবে সরকারকে ঢাকার চারটি নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার মূল ভূখণ্ড চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন এবং এসব নদীকে দূষণ এবং দখল থেকে মুক্ত করে তাদের আসল অবস্থায় ফিরিয়ে এনে রক্ষা করারও নির্দেশ দেন।

 

প্রশ্ন হলো, এসব নির্দেশ কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে? আমরা দেখতে পারছি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আমাদের তো একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকবে। সুতরাং হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কোনো প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে কী করে? আমলারা কী করে এসব প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করেন? তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন? উচ্চ আদালতের এই আদেশ কি সেই ডিপার্টমেন্টের ফাইলের তলেই পড়ে আছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব ডিপার্টমেন্টের অফিসারেরা তাদের দায়িত্ব পালনে নিদারুণ অবহেলার পরিচয় দিচ্ছেন। 

 

আজ সরকার একদিকে ভৌত অবকাঠামো উন্নত করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, অন্যদিকে তাদের নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের আন্তঃবিভাগ সমন্বয় করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। এদের কারণেই দেশ আজ এক ধাপ এগিয়ে যেতে না যেতেই দুই ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের একটি গল্প মনে পড়ছে। একবার ঘনবর্ষায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় গোপাল উপস্থিত হলেন দেরি করে। গোপাল রাজাকে বললেন, রাস্তা এত পিচ্ছিল যে তিনি এক পা এগোতেই পিছলে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজা তখন বললেন, তাহলে তুমি রাজসভায় এলে কী করে? গোপাল বললেন, আমি ঠিক করলাম রাজসভায় যাবই না। তাই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির দিকে এক পা এগোতেই দুই পা পেছাতে শুরু করলাম!

 

এখন উন্নয়নের সোজা পথে এক ধাপ এগোনোর পর যদি দেখা যায় আমরা দুই ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছি, তখন কি গোপালের মতো আমাদেরও উলটো দিকে হাঁটতে হবে?

 

ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে আরো একটি মজার তথ্য উল্লেখ করতেই হয়। এই নদীর ওই স্থানটি ২০১৮ সালেও ভরাট করা হয়েছিল। বিআইডব্লিউটিএ সেটা পুনর্দখল করে রক্ষা করে এবং পুনঃখনন করে। ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের প্ল্যান করার পরেও কিছু ক্ষমতাধর ভূমিদস্যু সরকারের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের যোগসাজশেই এই কাজটি করেছে। এভাবে খালগুলো উদ্ধার ও পুনর্দখল যদি চলতেই থাকে, তাহলে মেয়র সাহেবরা খাল পুনরুদ্ধার করে কি কেবল অর্থের অপচয় করছেন না? যদি এটি ভবিষ্যতে তুরাগের মতোই পুনর্দখল হয়, তাহলে মেয়র আতিকুল এখন বসিলায় যা করলেন, সেটা কি লোক দেখানো বা পাবলিকের সাময়িক হাততালি পাওয়ার চেষ্টা? মনে রাখতে হবে, প্রতিটি অ্যাকশনের সঙ্গে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধারাবাহিক ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং সেটা আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা অবকাঠামোতে ঢোকাতে হবে।

 

যেমনটি গাবতলী ব্রিজের নিচ দিয়ে যে রুগ্ন নদীটি তুরাগের কাছে গিয়ে প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামের কুক্ষিগত হওয়ার সংবাদও পত্রিকায় এসেছিল সেগুলোও পুনরুদ্ধার হয় আবার পুনর্দখলও হয়। এগুলো উদ্ধার করা হয় সরকারি অর্থে, বিআইডব্লিউটিএ দ্বারা। আর দখল হয় চাঁদাবাজি অথবা সাধারণ মানুষের নোনাঝরা রক্তের বিনিময়ে। এ প্রসঙ্গে মরুতীর্থ হিংলাজ ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গানটি মনে পড়ে— ‘তোমার ভুবনে মা গো এত পাপ/ এ কি অভিশাপ, নাই প্রতিকার/ মিথ্যারই জয়, আজ সত্যের নাই অধিকার।’

 

মনে হচ্ছে, দেশটা যেন কোনো মাস্টার পরিকল্পনা ছাড়াই স্বাধীনতার পর পাঁচটি দশক পার করে ফেলল! দুঃখের সঙ্গে আমরা দশকের পর দশক ধরে দেখে আসছি যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেই তাদের দলের লোকেরা দেশটাকে দলের সম্পত্তি মনে করা শুরু করে। তার কারণ কী? যতদিন মিলিটারি রেজিম থাকে তখন সেই রেজিম জনবিচ্ছিন্ন হয়েই জন উন্নয়ন করার চেষ্টা করে। সবাই তখন শাসক হয়ে ওঠেন; কিন্তু জনসেবক হন না। শাসক যে হন তার থেকে তার পারিষদ আরো বেশি শক্তিশালী হয়, অবশ্যই আড়ালে বা আবডালে।

 

এই মুহূর্তে দেশে আরো একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, সেটি হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অপসারণের ছাত্র আন্দোলন। এই ঘটনাটি এতদূর নিয়ে যাবারই কথা ছিল না। আমার মনে হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনকে পাত্তা দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করেননি সরকারের কেউ। তাতে যা হলো, সামান্য একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল তৈরি হলো। আর চারদিক থেকে যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থনের ঘটনা বাড়তে থাকল তখন সরকার নড়েচড়ে বসল। অথচ ঘটনার স্রোত এতদূর গড়ানোর আগেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো সরকারের কেউ এগিয়ে এসে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারল না— তোমাদের ওপর অন্যায় হয়েছে, এই অন্যায়ের মীমাংসা করা হবে, তোমরা অনশন ভাঙো। জাফর ইকবাল বুঝিয়ে দিলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে যথার্থ ভালোবাসা, মনোযোগ, সহানুভূতি ও ধৈর্য নিয়ে এগিয়ে গেলে তারা নিজেরাও আস্থা পায়। জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সেখানে যাওয়ার আগে এই যে শিক্ষার্থীরাও আস্থার জায়গা খুঁজে পায়নি, এটাও তো সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ব্যর্থতা। কেন তাদের ওপর আস্থা থাকবে না এসব অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের?

 

দেখা যাচ্ছে, সমন্বয়হীনতার অভাব সরকারের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কেউ রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন দেখছে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কেন কোনো জবাবদিহিতা নেই? অনেকে মনে করেন, এদের খামখেয়ালি অপকর্মের জন্য এরা শাস্তি পায় না বলে কেউ এসব বিষয় কেয়ার করে না। যার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সব সিদ্ধান্ত দিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এত জেলজুলুমের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিলেন। একটা দুটো দিন না, বঙ্গবন্ধুকে দেশের জন্য বিভিন্ন সময় ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানিরা এ দেশটিকে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে নির্বিচারে ধ্বংস করেছিল। সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু যখন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, তখনো চারদিক থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আর শেষ পর্যন্ত তার হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্বের কাছে পেরে উঠতে না পেরে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়! সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা, শেখ হাসিনা—যার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি আর দেশপ্রেমের রুধির, তার পাশে কেন থাকবে না ত্যাগী দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী নেতারা? শেখ হাসিনার দেশ গড়ার হাতটাকে শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর এত কুণ্ঠা কেন?

 

বাংলাদেশে কেন এরকম হচ্ছে? বাংলাদেশে অনেক ভালো লোকও তো আছে। কেন খারাপ লোকেরাই অধিক পরিমাণে ওপরের দিকে উঠছে, চেয়ার দখল করছে? নদী, খালবিল, সততা, মানবিকতা, সত্যনিষ্ঠতা, বন্ধুতা—সব কিছু গ্রাস করতে মরিয়া এরা। এরাই ষড়যন্ত্র করছে। এরাই সরকারের সব ভালো কাজের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে! বাঙালিরা ক্ষেত্রবিশেষে কত খারাপ, তার প্রমাণ তো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেই পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুকে তো পাকিস্তানিরা মারেনি, বাঙালিরাই মেরেছে! কিন্তু এই দেশ যদি স্বাধীন না থাকত, এই দেশ কি এতটা উন্নতির শিখরে যেতে পারত? পাকিস্তানির দুই যুগের জমানায় তো দেখা গেছে, ওরা আমাদের পুরো মুসলিম, এমনকি পুরো মানুষও মনে করত না। অথচ আমাদের যতটুকু সম্পদ আর রাজস্ব ছিল, সেগুলো ওরা নিজেদের প্রয়োজনে পশ্চিমে ব্যবহার করত। শোষণ ও বৈষম্য কাকে বলে সেটা আমরা সেই দুই যুগে দেখেছি।

 

সুতরাং এটা আমাদের বুঝতে হবে যে, এখন শেখ হাসিনাই আমাদের সবচাইতে বড় ত্রাতা। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনার জাগতিক কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। উন্নয়ন একটা রিলে রেসের মতো, সেটা বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। এখন সেই উন্নয়নের ব্যাটন শেখ হাসিনার হাতে। তিনি সেই ব্যাটন হাতে ছুটে চলেছেন রাতদিন। এই বয়সেও তার মতো পরিশ্রমী কজন আছেন? এই দেশ নিয়ে তার পিতার ত্যাগ-তিতিক্ষার কোনো তুলনা নেই, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি সুন্দর সোনার বাংলা—যে দেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না, কেউ কাউকে জুলুম করবে না, প্রভাবশালীদের লোভের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়বে না সাধারণ মানুষের অধিকার। এ দেশের মঙ্গল ছাড়া তাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। পিতার স্বপ্ন পূরণে শেখ হাসিনা শেষ চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে যে যেখানে আছেন, আমরা সবাই কি পারি না তার পাশে দাঁড়াতে? আমরা তো অনেকের জমানা দেখলাম, কিন্তু তার মতো দেশদরদি নেতা কি আর পাব? লালন বলেছেন, সময় গেলে সাধন হবে না। সুতরাং সময় থাকতে আমাদের এ সত্য বুঝতে হবে, দেশের মানুষের প্রকৃত উন্নতির স্বার্থে ষড়যন্ত্রকারীদের তাঁবেদার ও দোসর না হয়ে শেখ হাসিনার উন্নয়নকাজের প্রকৃত সঙ্গী হতে হবে। দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অধিকারকে রাজনৈতিক অধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন তার ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন—‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,/ বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।’

 

সুতরাং আমাদেরও সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে হবে। আর সাধারণ মানুষের জন্য যিনি জীবনপণ করছেন, সেই নেত্রীর পাশে থাকতে হবে।

 

 

লেখক: তাসমিমা হোসেন 

সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক ও পাক্ষিক অনন্যা

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ