শাবিপ্রবির উপাচার্যের মন্তব্যে প্রশ্নবিদ্ধ নারী স্বাধীনতা
নারীশিক্ষা নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে যুগের পর যুগ নেহাৎ কম লড়াই করতে হয়নি। গত শতাব্দীতেও নারী শিক্ষা বর্তমান সময়ের তুলনায় বেশ অনেকটা পিছিয়ে ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নারীদের সংখ্যা ছিলো হাতেগোনা আবার কোনো কোনো জায়গায় তো ছিলোই না৷ কিন্তু সমাজে দিনের পর দিন নারীশিক্ষা অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। নারী স্বাধীনতাও এসেছে পরিবর্তন। তবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে আমাদের মানসিক পরিবর্তন ঠিক কতটা এসেছে?
নারীদের লড়াই ও আত্মবিশ্বাসের জোরে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্র থেকে কর্মক্ষেত্র সবজায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছেন, মত প্রকাশ করছেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাদের পার করতে হচ্ছে পাহাড়সম বাঁধা। দেশে নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা দেয়া হচ্ছে, নারী শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে বিশেষ সুযোগ সুবিধা। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতায় কতটা পরিবর্তন এসেছে?
উত্তর খোঁজার জন্য আর সময় নষ্ট করতে হবেনা। বরাবর মাথায় প্রশ্ন ঘুরে আর সেই অনুযায়ী উত্তর খুঁজতে যাই। আজ উত্তর আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো যার জের ধরেই মাথায় প্রশ্ন জমা হলো। সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এর একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় নেট দুনিয়ায়। যেখানে তার কিছু মন্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ করে নারী শিক্ষাকে, নারীর স্বাধীনতাকে এমনকি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে। আর সেখানে থেকেই এ প্রশ্নের উৎপত্তি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক অডিও ক্লিপে শোনা যায় শাবিপ্রবির উপাচার্য বলছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ, সারা রাত এরা ঘুরাফেরা করে। শাবিপ্রবির ক্যাম্পাসের চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই ভাইরাল হয় তার এসব মন্তব্য।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের ছাত্রীরা। পরেরদিন শনিবার সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগ হলের ছাত্রীদের ওপর হামলা চালায়। এতে ছাত্রীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়।
পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ , শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ঘোষণা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
ক্যাম্পাসের এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই ১৮ জানুয়ারি শাবিপ্রবির উপাচার্যের এই অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। ভাইরাল হওয়া অডিওতে ভিসিকে বলতে শোনা যায়, ‘যারা এই ধরনের দাবি তুলেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় সারা রাত খোলা রাখতে হবে, অবশ্যই এই দাবিটা এসেছে এবং এইটা একটা জঘন্য রকম দাবি। আমরা মুখ দেখাইতে পারতাম না। এখানে আমাদের ছাত্রনেতারা বলছেন যে জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ সহজে বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ, সারা রাত এরা ঘুরাফেরা করে। বাট আমি চাই না যে আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, তারা এখানকার সুন্দর সুন্দর ডিপার্টমেন্টগুলো থেকে পড়ে বিখ্যাত শিক্ষকদের সাহচর্য পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়, তাদের ওপর এ রকম একটা কালিমা লেপুক।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন মন্তব্য ভাইরাল হওয়ায় অনেক সমালোচনার মুখে পড়েছেন শাবিপ্রবি ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। কথায় বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মুখ থেকে এমন মন্তব্য যেনো দেশের সকল অগ্রগতিতে একমুহূর্তে ছুরিকাঘাত করলো। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অনায়াসে নারীরা সামলাচ্ছে সে দেশে একজন উপাচার্যের মুখে এসব কথা শুধু নারী স্বাধীনতাকে নয় নারীর সফলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমাদের দেশে এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইভটিজিং, হয়রানি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোর জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। ধর্ষণ হওয়া নারীর দিকে ছুড়ে দেয়া হয় , 'তোমার পোশাক কি ছিলো, একা একা ঘরের বাইরে কেনো গিয়েছিলে, রাতের বেলা মেয়েদের বাইরে কি?' এমন এক গাদা প্রশ্ন।
বেশি দূরে নয় একটু ২০২১ সালের পরিসংখ্যানের দিকেই তাকানো যাক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৩৫ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসবের বিপরীতে আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছি নারীর স্বাধীনতা নিয়ে।
ঠিক যেমনটা প্রকাশ পেলো শাবিপ্রবির উপাচার্যের কথায়, তিনি তার ক্যাম্পাসের মেয়েদের নিরাপত্তা জোরদার করার পরিবর্তে প্রশ্ন তুলেছেন, মেয়েদের রাতের বেলায় বাইরে থাকা নিয়ে। তার মতো অতি উচ্চশিক্ষিত মানুষ যখন নারী স্বাধীনতা নিয়ে এমন প্রশ্ন তুলছেন, তখন আর পাঁচজন সাধারণ মানুষও একই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন এটাই স্বাভাবিক।
দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ঠিক কোন দিকে ইঙ্গিত করে? তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে মন্তব্য করলেও, তার মন্তব্য যেন ফুটিয়ে তুলেছে নারীদের প্রতি, নারী শিক্ষার প্রতি, নারীর স্বাধীনতার প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা।