আর কত রক্ত দিলে, ঘুচবে রক্তশুন্যতা?
বিবাহ, সন্তান লালন পালন, রান্নাবান্না যদি একজন মানুষের জীবনে আবশ্যিক শিক্ষা হয় তাহলে স্বাস্থ্য রক্ষা কেন নয়? একজন নারী বা একজন পুরুষ, তার দৈনন্দিন জীবনের খাওয়া-দাওয়ার রুটিন এবং বেসিক লাইফ স্কিল নিয়ে হবে সচেতন। তবে নারী ও পুরুষের শারীরিক স্বাস্থ্যগত ভিন্নতা থাকে। এজন্য তাঁদের পুষ্টির চাহিদাও থাকে ভিন্ন।
যেমন, আয়রন সংকট। রক্তের আয়রনের ঘাটতি থাকলে তখন সেটা কে রক্তশূন্যতা বলা যায়। নারীদের রক্তশূন্যতার যে হার সেটা পুরুষের তুলনায় বেশি। কারণ নারী-পুরুষের শরীরে আয়রনের চাহিদা সমান থাকেনা। বরং নারীদের আয়রনের চাহিদা অপেক্ষাকৃত বেশী হয়৷ বাংলাদেশে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ রক্ত শুন্যতায় ভোগে। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই নারী। দেশের প্রায় ৪২ ভাগ নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। রক্তস্বল্পতা মূলত অনেক কারণেই হয়ে থাকে। তার মধ্যে কিছু বিশেষ কারণ হচ্ছে, সন্তান জন্মদানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, পিরিয়ডের সময় পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া, লোহিত রক্ত কনিকা(রেড ব্লাড সেল) নষ্ট হলে বা উৎপাদন কম হলেই তাকে রক্তশূন্যতা বা রক্তস্বল্পতা বলা হয়।
এর মধ্যে বেশীর ভাগ ভুক্তভোগীই হলেন গ্রামাঞ্চলের নারীরা। কারণ রক্তশুন্যতা নিয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান তাঁদের কাছে সহসা পৌছায়না। গ্রামাঞ্চলে নারীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। যার কারণে, তাঁরা নিজের যত্ন নেয়া সম্পর্কে এখনো অপরাগ৷ কোন খাবার খেলে শরীরে আয়রনের চাহিদা পূরণ হবে, কোন খাবারের পুষ্টিমান কি সে সম্পর্কে উনাদের জানার পরিসর হয় সীমিত। অনেকে জানেনই না আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে হলে খাদ্যাভ্যাসে পুষ্টিকর খাবার তালিকাভুক্ত করার বিকল্প নেই। অনেকে আবার অর্থ সংকটে পড়ে গিয়ে নিজের প্রতি যত্নশীল থাকেন না। তবে এ ধারনাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আয়রনের উৎস কেবল মাছ, মাংস, দুধ, কলা থেকেই বেশী পাওয়া যায় তেমন না। সবুজ শাকসবজি, কচুশাক, পেয়ারার মত অনেক ফলমূল ও রক্তস্বল্পতা থেকে বাঁচায়।
রক্তস্বল্পতা হওয়ার আগেই যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায় সেক্ষেত্রে অনেক নারীই সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা যায়। যেমন, রক্তস্বল্পতা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু, রক্ত শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে সেহেতু, রক্তশুন্যতা হলে অনেক বেশী ক্লান্ত লাগা, ক্ষত চিহ্ন না শুকানো, সারাক্ষণ দুর্বল লাগার মত জটিলতা দেখা দেয়। যা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটাই স্তিমিত করে দেয়।
আবার কখনো কখনো রক্তশুন্যতা অনেক তীব্র রূপ ও ধারণ করতে পারে। যেমন, ক্যান্সার, লিভার ফেইলিউর, কিডনি ফেইলিউরের মত অনেক মারাত্মক ব্যাধি। নারী সন্তান জন্মদানের ৪০ দিনের মাথায় যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে তাকে প্রসবকালীন মৃত্যুই বলে। গর্ভবতী থাকাকালীন নারীর শরীরে যেহেতু হিমোগ্লোবিন এর মাত্রা আরো কমে যায় তাই অনেক নারী সন্তান জন্মদানের পর নানা জটিলতায় মারা যান।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের গবেষণা অনুযায়ী, ৪২ ভাগ নারীদের মধ্যে ৬৫ ভাগ নারীই গ্রামীণ জনসংখ্যা। বয়সন্ধিকালীন মেয়েদের মধ্যে রক্তশূন্যতার প্রাদুর্ভাব শতকরা ৪৩ ভাগ। অ-গর্ভবতী নারী মধ্যে সেটার হার ৪৫ ভাগ এবং গর্ভবতী শতকরা ৪৯ ভাগ। চিকিৎসকবৃন্দের ভাষ্যমতে, একজন নারীর পুরুষের তুলনায় অনেক বেশী আয়রনের প্রয়োজন হয়। পুরুষের যেমন দৈনিক আয়রন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা থাকে ৮ মিলিগ্রাম। সেখানে নারীর দৈনিক প্রয়োজনীয়তা হয় ১৮ মিলিগ্রাম। কারণ অনেকখানি রক্তই মাসের একটা সময়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
রক্তশুন্যতা দূরীকরণের জন্য খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবার তালিকাভুক্ত করা টা খুবই জরুরী। মাছ, মাংস, ডিম, কলা, বাদাম, দুধ, সবুজ শাকসবজি ও ফল এবং আয়রন ট্যাবলেট এবং সবুজ শাকসবজি অবশ্যই থাকতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বেশী বেশী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বেশী বেশী ক্যাম্পেইন করা যত হবে তত নারীরা নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে। অবশ্যই গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে পরিবার এবং এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্য কম্পপ্লেক্স এর সদস্যদের।
অনেকেই মনে করে পিরিয়ড এর কারণে নারীদের হিমোগ্লোবিন কম থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ থেকে নিচে নামা মানেই সেটা কে রক্তশুন্যতা বল ধরে নেয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা এখনো নিবিড়ে অবস্থান করছে। যতটা সময় এবং জ্ঞান একজন নারীর চারিত্রিক বিশ্লেষণে দেয়া হয় ততটা যদি শিক্ষা অর্জন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও মানবিক খাতে দেয়া হতো তাহলে কি একটা ভিন্ন সমাজ দেখতে পেতাম না? অন্তত, জ্ঞানের স্বল্পতায় একজন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর চেয়ে অবহেলিত আর কি আছে?