পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা: নারী তো বটেই, পুরুষও আক্রান্ত
যেহেতু নারী দাঁড়িপাল্লায় মূল্যায়নের বস্তু বলে শত শত বছর ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে, সেহেতু নারীকে প্রতি পদে বিচার-নিষ্পত্তির আওতায় আনাটা স্বাভাবিক। একজন নারীকে প্রতিনিয়ত তার পারিপার্শ্বিকতার বিবেচনা করতে হয়৷ প্রেম, বিয়ে বা কর্মজীবনের অগ্রগতি হোক। সে ইচ্ছে করলেই হর হর করে সমস্ত অন্যায় নিয়ে কথা বলতে পারে না।
একজন নারী যদি তার অসুস্থ বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তবে তাকে বিচ্ছেদ পরবর্তী জবাবদিহিতার কথাও চিন্তা করতে। অনেক সময় এই সকল জবাবদিহিতাও তার পরিবারের কাছে যথেষ্ট বলে মনে হয় না৷ বিবাহ বিচ্ছেদ মানে একজন নারীর কলঙ্ক। সবাই তো নারীকেই ছিঃ ছিঃ করবে। কারণ মানিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা তো নারীর থাকা উচিত৷ একজন নারী কেনো সংসারে ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে পারবে না? নারী হিসেবে এটা তো একটা ব্যর্থতার পরিচয়।
পুরুষ ও নারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এ সমাজে ভাগ করা আছে। নারী মানে গোছানো, পরিপাটি, শান্ত ও সাংসারিক। কিন্তু পুরুষ হবে অগোছালো, অমনোযোগী সাংসারিক ব্যক্তিত্ব৷ তবে কেবল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, খাবার ও পোশাক পরিধানের নিয়মেও ভিন্নতা রয়েছে৷ ওড়না পেঁচিয়ে ঘর থেকে বের না হলে নাকি সমাজ ও দেশের মানসম্মান অব্যাহত থাকে না৷ কিন্তু পুরুষ হাফ প্যান্ট পড়ে বের হলেও মানসম্মান যায় না। কারণ এ সমাজে পুরুষের কলঙ্ক ধরার চল নেই।
পুরুষের জন্য কেবল রয়েছে গাধার মত খাটুনির ব্যবস্থা। দিন-রাত অর্থ উপার্জনের জন্য যারপরনাই খাটুনির আয়োজন। তার কাজ হচ্ছে পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করা। তবে অর্থনৈতিক ক্ষমতাই যে সবচেয়ে বড় ক্ষমতা সেটা ভুলে গেলে চলবে না। যার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আছে সে চাইলেই অন্য কে অবদমন করতে পারে। তাই এ সমাজকে কেবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলাও চলবে না। এ সমাজ কে বলতে হবে শোষিত এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
এখন বিষয়টি এরূপ, শোষিত ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে কীভাবে নারী নিপীড়িত?
পুরুষেরা শোষিত সমাজের প্রজা হিসেবে যদি কাজ করে থাকে, তাহলে তারা একসময় অপেক্ষাকৃত বেশী বলবান ও সমাদর পেয়ে নিজেকে মন্ত্রী ভাবা শুরু করে আর সকল নিয়ম কানুন আর সুবিধা নিজে ভোগ করতে চায়। এখন কোনো প্রজা যদি রাজ্যের সকল সুবিধা ভোগ করতে চায় তাহলে তাকে রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে৷ এবং যদি আনুগত্য প্রকাশে কোনো প্রজা ব্যর্থ হয় তাহলে সে সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে৷ কখনো কখনো ত্যাজ্যও হয়ে যেতে পারে। যে রাজ্যের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করে কিংবা শ্বাসরুদ্ধকর বলে মনে করে তার চরিত্র এবং মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে। তথাপি সেই নারীকে কলঙ্কযুক্ত বলে ঘোষণা দেয়া হবে৷
তবে এই সমাজের শোষকেরা কি কেবলই পুরুষ? না এই সমাজের শোষকেরা পুরুষের সাথে সাথে কিছু নারীও আছেন৷ নারীরাই নারীদের বিভিন্ন তকমা দিয়ে তাদের সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে৷
এর গোড় সূত্র যদিও ভীতি। হাজার হাজার বছর ধরে আরোপিত কলঙ্ক নারীদের ক্লান্ত করে শোষিত সমাজে পুরুষের নিয়মে চলতে বাধ্য করেছে৷ একজন নারী জানে সে যাই করবে তাতেই লোকে তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে। তাতে সারাজীবন নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করে যেতে হবে। হয় ইট পাটকেল খেতে হবে নয়তো কলঙ্করোধের দেয়াল তৈরি করতে হবে৷