নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া!
সাল ১৮৮০, যখন সমাজে নারীর অবস্থান একদম তলানিতে বললেও ভুল হবেনা। যখন নারীর পরিচয় বলতে আলাদা কিছু ছিলোনা। ছিলোনা শিক্ষার অধিকার, স্বাধীনভাবে চলার অধিকার। সেই সময়টাতেই জন্ম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের। আজ থেকে ১৪১ বছর আগে জন্মগ্রহণ করা এই নারী পাল্টে দিয়েছিলো আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের তথাকথিত কিছু সংজ্ঞা।
তৎকালীন সমাজে নারী শিক্ষার জন্য মশাল হাতে নিয়ে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া৷ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে। তাঁর বাবা আবু আলী হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড় দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় তিনি গোপনে শিক্ষালাভ ও সাহিত্যচর্চা করেন।
তবে সহযোগী মনোভাবের ছিলেন তাঁর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন উদার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি। স্বামীর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণেই তার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের লেখকদের রচনার সাথে পরিচিতি ঘটতে থাকে।
কিন্তু ১৯০৯ সালে স্বামী মারা গেলে বেগম রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তবে শোকে বিহ্বল হয়ে থেমে যাননি তিনি। বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় মাত্র ১৮ বছর বয়সে এবং ২৮ বছর বয়সে তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী নিয়ে ভাগলপুরে সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় তাঁকে। অতঃপর তিনি স্কুলটিকে কলকাতায় স্থানান্তর করেন। কলকাতায় এসে তাঁর শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ৮-এ।
তখনকার সময়ে মুসলিম সমাজ মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ছিলো খুবই কঠোর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ অনেকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও সেখানে মুসলিম মেয়েরা পড়াশোনা করতে যেত না। মোট কথা মেয়েদের অভিভাবকদের নারীশিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না।
ফলে বেগম রোকেয়াকে একদিকে শিক্ষার্থী সংগ্রহের জন্য অভিভাবকদের বোঝাতে হতো, অন্যদিকে স্কুলের ব্যয় নির্বাহের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হতো। ১৯০২ সালে নভপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পান। ১৯৫০ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সুলতানাস ড্রিম’ যার বাংলা অর্থ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের মাধ্যমে সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ হলো- পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। বেশিরভাগ প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্যদিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। খুব সাবলীল ভঙ্গিতে কখনো আবার কখনো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তোলেন।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি জরিপের আয়োজন করে। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। সেই শ্রেষ্ঠ কুড়ি জনের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন আমাদের বেগম রোকেয়া।
বর্তমানে নারী শিক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজ বেশ অনেকটাই সচেতন। নারীরা আজ স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ পাচ্ছে, শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। স্বামী কিংবা পরিবারের পরিচয়ে নয় নারী তৈরি করছে নিজের পরিচয়। আজ থেকে ১৪১ বছর আগে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নারী জাগরণের এই পথ দেখিয়েছিলো যে নারী আজ তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।