এক নজরে কমলা ভাসিন!
বর্তমান সময়ে নারীবাদ বিষয়টি নিয়ে চারদিকে রয়েছে বেশ নেতিবাচকতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীবাদ এবং নারীবাদের চর্চাকারীদের অনেকটা নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখা হয়। এর প্রধান কারণ বলা যায়, নারীবাদ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা সমাজে ঘুরপাক খাওয়া। সে যতই নেতিবাচক দিক থাক না কেন, যুগে যুগে নারীর অধিকার আদায়ের কাণ্ডারি হিসেবে নারীবাদীদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনি এক কাণ্ডারি কমলা ভাসিন।
১৯৭০ সাল থেকে ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন কমলা ভাসিন। তিনি একাধারে একজন ভারতীয় উন্নয়নশীল নারীবাদী কর্মী, কবি, লেখক এবং সমাজ বিজ্ঞানী। কমলা ভাসিনের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার ভারতের রাজস্থানে চলে যায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বড় ছিলেন। তাঁর বাবা রাজস্থানের একজন ডাক্তার ছিলেন। তাঁর বেড়ে ওঠা ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। তাই ছোটোবেলা থেকেই তিনি ভারতের গ্রামগুলোতে নারীর সমস্যাগুলো চোখের সামনে দেখতে পান। যা তাঁর পরবর্তী জীবনে অনেকটা কাজে লাগে।
একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তাঁর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন। তাঁর সাংসারিক জীবনেও ছিলো বেশ অনেকটা ভরাডুবি। সেবা মন্দির এর জন্য কাজ করার সময় রাজস্থানে দেখা হয় তাঁর স্বামীর সঙ্গে। সমাজের আর পাঁচজন সাধারণ পুরুষের তুলনায় সেই লোকটি ছিলো অনেকটাই ভিন্ন। তাঁর মধ্যে ছিলো নারীবাদী মনোভাব যা কমলা ভাসিনকে মুগ্ধ করে। দুজনই প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ হয়েও একটা সময় বিচ্ছেদ ঘটে এই যুগলর মধ্যে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সবথেকে বড় আঘাত আসে তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক বড় মেয়ের মৃত্যুতে।
তবে ব্যক্তিগত জীবনের কোনো তিক্ততা, হতাশা কিংবা কষ্টে নিজেকে ঘরের এককোণে আটকে রাখেননি এই নারী। তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবন ছিলো বেশ অনেকটাই বৈচিত্র্যময়। তিনি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তারপরে ফেলোশিপ নিয়ে পশ্চিম জার্মানির মুয়েনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এরপরে, তিনি বাড হনেফ এর জার্মানি ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ এর ওরিয়েন্টেশন কেন্দ্রে প্রায় এক বছরের জন্য শিক্ষকতা করেন।
একবছর শিক্ষকতার পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন, আর তাঁর সমস্ত শিক্ষা এখানে বাস্তবায়ন করার ইচ্ছে পোষণ করেন। তার ধারাবাহিকতায় শুরুতেই তিনি সেবা মন্দিরের জন্য কাজ শুরু করেন। আর সেখান থেকে তিনি ভারতীয় সমাজে প্রচলিত জাতিগত ও লিঙ্গভেদের বৈষম্য সম্পর্কে অবলোকন করেন৷ আর তারপর থেকেই নারী আন্দোলন নিয়ে বেশ সোচ্চার ভূমিকায় দেখা যায় এই নারীকে। নারীর সমান অধিকার, সম্মানের জন্য একের পর এক লড়াই করে গেছেন তিনি।
সত্তর দশক থেকে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকা কমলা ২০০২ সালে একটি ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রান্তিক, আদিবাসী নারীদের প্রশিক্ষিত করার কাজ করতেন। তিনি জাতিসংঘে কর্মরত থাকলেও পরে এই নেটওয়ার্কের কাজে বেশি সময় দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন।
লিঙ্গ তত্ত্ব, সমতা, মানবাধিকার, পুরুষ-তন্ত্র নিয়ে লেখা কমলার বইগুলি অন্তত ৩০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সতরঙ্গি লাড়কে’, ‘সতরঙ্গি লাড়কিয়া’ ইত্যাদি। এসব বইয়ে তিনি সরাসরি কথা বলেছেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে নিয়ে।
কমলা ভাসিন বিশ্বজুড়ে আলোচিত ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ২০১২ সালে শুরু হওয়া এক প্রচারণার নাম 'ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং'। কমলা কথা বলেছেন বিজ্ঞাপনী পণ্যতে নারীদের উপস্থাপন নিয়েও। বিজ্ঞাপনী পণ্যতে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় সেই বিষয়টিকে অন্যায় হিসেবেই দেখতেন তিনি।
২০১৭ সালে তিনি ‘লাডলি লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছিলেন। ২০২০ সালে তিনি বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে 'ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং' প্রচারণার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন। শুধু নারীবাদিত্বই নয় নারীবাদী এ কবি, লেখক তিন দশক ধরে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করেছেন। আজ তাঁর মৃত্যুতে শুধু ভারতেরই নয় দক্ষিণ এশিয়ার নারী অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে যেনো এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হলো!