নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের সময় এখনই
নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে বোঝায় কারো দ্বারা একজন নারীর যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, এসিড নিক্ষেপ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সহিংস আক্রমণের মতো অপরাধের শিকার হওয়া। বাংলাদেশে দিন দিন এই নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে গ্রাম, শহর নির্বিশেষে সকল স্থানের নারীরাই এখন এই ঘৃণ্যসব সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা যেন দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। প্রতিনিয়তই কোন না কোন নারী অপরাধের শিকার হচ্ছে।
ইউনাইটেড নেশন পপুলেশন ফান্ডের জরিপে মতে, নারী নির্যাতনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এর অধিকাংশই পারিবারিক শারীরিক নির্যাতন। নারীর প্রতি শতকরা ৮০ ভাগ সহিংসতা ঘটে পরিবারের ভেতরে। দেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃত্যু ঘটছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারণে। আগে মনে করা হত, নির্যাতনের ঘটনা গ্রামাঞ্চলেই বেশি ঘটে। কিন্তু শহরাঞ্চলেও শতকরা ৬০ ভাগ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে ছয়শটি। নারী ও শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মাত্রা প্রতি বছর বাড়ছে। পুলিশের হিসাব মতে, গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগ আসে। ধর্ষণের কারণে ১২ টি শিশু এবং ২৬ জন নারীর মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর তথ্য মতে, এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ।
নারীর প্রতি এই অসম্মান, লাঞ্ছনা কেবল নারীকেই না সমাজকেও টেনে পিছিয়ে নিয়ে যায়। তাই নারীর প্রতি এই সহিংসতা রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
নারীরা সামাজিক প্রথার মতো যুগ যুগ ধরেই পুরুষের কাছ থেকে সহিংসতার শিকার হয়ে আসছে। অনেক পুরুষ আবার নারী নির্যাতনকে নিজের সংস্কৃতি মনে করেন। নারীর প্রতি এসব নির্যাতন রোধে সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজের যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা তা পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। তরুণ সমাজকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন রোধে তরুণ সমাজকে সবার মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। একজন পুরুষকে বুঝতে হবে নারী নির্যাতন প্রথা নয়, অপরাধ। নারীরাও তাদের মতো স্বাভাবিক মানুষ।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে পারবে। পারিবারিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌতুকের কারণে নির্যাতন এই অপরাধগুলো কিন্তু পরিবার থেকেই করা হয়। তাই পরিবারকে এদিক থেকে সচেতন হতে হবে এবং নারীর প্রতি সহনশীল হতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যা রাখতে পারে তা হল প্রশাসন ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি নারী সহিংসতা রোধে আইন প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নে কড়াকড়ি নজর দেয় তাহলে এসব অপরাধ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ যেতে পারেনা, তাই আইনের কড়া নজরদাড়ি অনেকাংশে নারীর ওপর সহিংসতা রোধ করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও নারীকে নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। একজন নারী যদি নিজের ব্যাপারে সচেতন হন তাহলে নিজেই নিজের সাথে হওয়া অপরাধের প্রতিবাদ করতে পারবে। এছাড়া নারীশিক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধা থাকতে হবে।
একটা সমাজ কতটুকু গণতান্ত্রিক ও মানবিক তার নির্ণায়কের মধ্যে অন্যতম হল একটি দেশে নারীরা কতটা স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও জীবনযাপন করে। কিন্তু এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার যে, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা হ্রাসের পরিবর্তে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদের একেবারেই কাম্য নয়। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই। সবাইকে এই সহিংসতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।