বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট!

১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী৷ একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান৷ নাম রাখা হয় কানিজ ফাতেমা রোকসানা। তখনকার সমাজব্যবস্থা নারীর জন্য ছিল খুবই রক্ষণশীল। কিন্তু সেই রক্ষণশীল সমাজে থেকেও ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকেননি, স্বপ্ন সত্যি করে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। হয়েছেন দেশের প্রথম নারী পাইলট৷
তবে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে হুট করেই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে পারেননি তিনি। এজন্য সমাজ ও নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়াই চালাতে হয়েছে তাঁকে। প্রথম নারী পাইলট হিসেবে তাঁর নামটি অনেকেরই পরিচিত হলেও সে লড়াইয়ের কাহিনী প্রায় সকলেরই অজানা।
কানিজ ফাতেমা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং নানান গুণে পারদর্শী একজন নারী। ছিলেন রেডিও ও টেলিভিশন জগতের নামকরা একজন সঙ্গীতশিল্পী৷ তৎকালীন সময়ে জার্মান ভাষার ডিপ্লোমাধারী। যা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। হাতের সামনে ছিল জার্মানির মেডিকেলের স্কলারশিপ। চোখের সামনে উঁকি দিচ্ছিল উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ। তবে তিনি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত নিচে থেকে নয় জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছেন নীল আকাশে উড়তে উড়তে। তাইতো অনায়াসে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জার্মানির মেডিকেলের স্কলারশিপ৷ তারপর বিএসসিতে ভর্তি হন ইডেন কলেজে।
কিন্তু পাইলট হওয়ার স্বপ্ন কখনোই তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাইতো ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব খুঁজে বের করে সেখানে যোগ দেন। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ১৯৭৮ সালে পেয়ে যান কমার্শিয়াল বিমান চালানোর লাইসেন্স। শুধু তাই নয়, সাথে পান সহ-প্রশিক্ষকের লাইসেন্স। যার মাধ্যমে বহু শিক্ষানবীশকে প্লেন চালানো শেখালেন। আর এভাবেই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তাঁর এগিয়ে চলা শুরু।
এরপরই একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপন দেখে পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্ত ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ আর চিরাচরিত নিয়ম। একজন নারীর প্লেন চালানো মানতে নারাজ সকলেই। তাইতো পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া সত্যেও বাংলাদেশ বিমান তাঁকে নিয়োগ দেয়া নিয়ে বিভিন্ন গড়িমসি করে এবং সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগে কেবলমাত্র পুরুষেরা আবেদন করতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন।
তাঁকে দমিয়ে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সকল মহল থেকে। কিন্তু কোনভাবেই থেমে থাকেননি এই নারী। বরং প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। ৩১ মে ১৯৭৯ তারিখে এ বিষয়ে প্রতিবাদস্বরূপ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ বিমান বনাম মহিলা বৈমানিক’ শিরোনামে একটি চিঠি লিখেন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন ‘মহিলা হিসাবে আমি একবিন্দু সুবিধা চাই না বা কোটার সমর্থকও আমি নই, যদি আমি পুরুষের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি, তবে শুধু মেয়ে হইয়া জন্ম নেওয়ার জন্য আমাকে যেন আমার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত করা না হয়।’
এরপরই বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা সমালোচনা। যা পৌঁছে যায় সংসদ পর্যন্ত। একজন নারীর লড়াইয়ে সামিল হন জাতীয় সংসদের নারী সদস্যগণ। অবশেষে তাদের প্রচেষ্টায় সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের বিজ্ঞাপন থেকে নারী পুরুষ বৈষম্যের শর্ত সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। যার ফলে পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেতে তাঁর আর কোন বাঁধাই ছিলোনা। এরপর ১৯৭৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের প্রথম মহিলা পাইলট হিসাবে নিয়োগপত্র লাভ করেন এই নারী।
তবে তাঁর আকাশে ডানা মেলে ওড়ার পালা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নিয়োগের পাঁচবছরের মাথায় ১৯৮৪ সালের ৫ই অগাস্ট বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টা ভয়ংকর বিমান দুর্ঘটনা রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ফকার এফ-২৭ বিমানে করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বৃষ্টিবিঘ্নিত আবহাওয়ার কারণে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। সেবার ৪৫ জন যাত্রীসহ ৪ জন ক্রু সদস্য নিহত হয়।
তাঁর ভালো নাম সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা হলেও ডাকনাম ছিল তিতলী। তিতলী অর্থ প্রজাপতি। নামের মধ্যেও ছিল অদৃশ্য ডানা আর মনের মধ্যেও ছিল আকাশে ওড়ার প্রবল বাসনা। তাইতো নাটকীয় ভাবে তাঁর জীবনের ইতিও ঘটে সেই আকাশে উড়তে উড়তেই। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর মধ্যাকার সময় খুব কম হলেও তিনি সেই অল্প সময়টাতেই রচনা করেছেন নতুন ইতিহাস। উড়তে শিখিয়ে গেছেন পরের প্রজন্মের নারীদের।