‘ভালো নাই আমরা’
‘না পাইলাম ত্রাণ, না থাকলো কাজ। না খাইয়া যে মরিনাই এইডাই অনেক আমাগোর লাইগা’- কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার এক গৃহকর্মী পারুল বেগম। মিরপুর কমার্স কলেজের পাশে এক বস্তিতে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। একেবারে যে অভাবের সংসার তা না। বরং ছেলেমেয়েরাও ঠিকমতো পড়ালেখা চালিয়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু করোনা মহামারি তার এই সংসারকে ফেলে দিয়েছে এক বিশাল সংকটে। আর্থিক অভাবে এখন দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারছেনা পারুল ও তার পরিবার।
২০১৯ সালের শেষে পুরো পৃথিবীকে বিপাকে ফেলে প্রাদুর্ভাব হয় করোনা ভাইরাসের। ক্রমেই এই করোনা ভাইরাস মহামারির আকার ধারণ করে। ২০২০ এর মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। দেশে করোনা প্রতিরোধে সরকার দিয়ে দেয় কঠোর লকডাউন। স্কুল, কলেজ, অফিস- আদালত, সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় সবই থাকে বন্ধ। অতি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়াতেও থাকে নিষেধাজ্ঞা। ফলে অনেকেই কাজ হারায় এই লকডাউনের কারণে। দুর্বিসহ দিন নেমে আসে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের। এর মধ্যে গৃহকর্মীরা অন্যতম।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজসহ (বিলস) পাঁচ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা দলিল ‘গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র: পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ২০২০’–এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গৃহকর্মীর প্রায় ২০ লাখ। তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই শহরে কাজ করে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, শুধু রাজধানীতেই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশের শ্রম শক্তির একটি বিরাট অংশই গৃহকর্মী কাজে নিয়োজিত। গৃহকর্মীর পেশায় সাধারণত নারীদেরই বেশি দেখা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গৃহকর্মী পেশায় যুক্তদের ৯০ শতাংশই নারী ও মেয়েশিশু। গ্রাম বা মফস্বল থেকে তারা শহরে এসে পাড়ি জমায় কাজের জন্য। মানুষের বাসায় কাজ করেই তাদের জীবন চলে। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে সরকারি লকডাউনে অনেক গৃহকর্মীরাই কাজ হারান। সচেতনতার জন্য অনেক বাসাতেই গৃহকর্মী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপণ করা হয়। ফলে কাজ হারিয়ে বাসাতেই বসতে হয় তাদের। এদেরই একজন হলেন পারুল। করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলেছেন তিনি।
পারুলের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার হাদল ইউনিয়নে। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। কাশেম আলীর সাথে বিয়ে হবার পর জীবিকার তাগিদে নয় বছর আগে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে। প্রথম দিকে বেশ সংগ্রাম করেছেন এই দম্পতি। কিন্তু বছর দুইয়ের মধ্যেই মোটামুটি একটা অবস্থায় আসেন তারা। স্বামীর ভাড়া রিক্সা চালানোর টাকা আর তার আয়ে মোটামুটিভাবেই চলছিলো তাদের সংসার। তখন পারুল দুটি বাসায় খন্ডভাবে গৃহকর্মীর কাজ করতো। এরমধ্যেই দুই সন্তানের মা হন পারুল। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় তিনিও কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। কাজ নেন আরো তিনটি বাড়িতে। এতে আয় মন্দ হতোনা। আর স্বামীও প্যাডেল চালিত রিক্সা থেকে অটোরিক্সা চালানো শুরু করলো। যদিও তা ভাড়ার রিক্সা ছিল তবে আয় যা হত তাতে তাদের চারজনের সংসার চলে যেতো। ছেলেমেয়ে দেরকেও ভর্তি করে দেন সরকারি স্কুলে।
এরমধ্যেই করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় সরকার লকডাউন দিলে পারুল ও তার স্বামী দুজনেরই কাজ চলে যায়। পারুল তিন বাড়ির পাঁচটি ফ্লাটে কাজ কাজ করতো। কিন্তু করোনার প্রথম লকডাউন শুরু হলে সেই বাড়িগুলোতে যেকোনো গৃহকর্মীর প্রবেশ নিষেধ হয়ে যায়। নিরাপত্তার খাতিরে তাদের কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। অধিকাংশ গৃহকর্মীই একাধিক বাড়িতে কাজ করে থাকেন। এক্ষেত্রে করোনা ছড়ানোতে তারা বেশ বড় একটি ভূমিকা রাখতে পারে এই শঙ্কায় অনেক পরিবার থেকেই গৃহকর্মীকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়। তাদের মধ্যে পারুলেরও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ টাকা দিলেও অনেকেই মাসের পুরো টাকা না দিয়েই কাজ বন্ধ করিয়ে দেয়। প্রথম মাস মোটামুটি কাটলেও খুব শীঘ্রই আর্থিক সংকটের মুখে পড়তে হয় পারুলকে। ত্রাণের জন্য হাজার চেষ্টা করেও দুইদিনের বেশি ত্রাণ পাননি পারুল। তারপরও তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিলোনা সেই ত্রাণ। জমানো অর্থ দিয়ে আর কতদিন! দিনে দুবেলা খাবার যোগাড় করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো তাদের কাছে। এরমধ্যে যাদের কাছে টাকা পাওয়া বাকি ছিল তাদের কাছে যান পারুল। তারা টাকা শোধ করলেও পুনরায় কাজে না রাখার কথা তাকে জানায়। তবে পারুলকে আশ্বাস দেয় যে, লকডাউন শেষ হলে পুনরায় তাকে কাজে নিয়োগ দিবেন তারা। ২০২০ সালের এক জরিপের তথ্য মতে, করোনা পরিস্থিতিতে ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মীই বেকারত্বের মুখে পড়েন। লকডাউন খোলার প্রথম অবস্থায়ও এই হার মোটামুটি অপরিবর্তিতই ছিল।
লকডাউন শিথিল হতে থাকলে পারুলও ধীরে ধীরে কাজে ফিরে আসতে থাকে। তবে সব কাজ পুরোপুরি ফিরে পায়না সে। অনেক বাসাই পুনরায় তাকে আর কাজে নিয়োগ করেনি। আবার পাঁচ ফ্ল্যাটের মধ্যে একটিতে তিনি ছাত্রদের রান্নার কাজ করে থাকতেন। কিন্তু করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ফলে পারুলেরও আর সেখানে কাজ কি! আর এর মধ্যে এক ফ্ল্যাটে করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ায় সেখানেও বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দেন তিনি। এভাবে শেষমেষ দুটি ফ্ল্যাটেই কাজ করছিলেন তিনি।
টানাপোড়নের মধ্যে হলেও পুনরায় শুরু হয়েছিলো তাদের সংসার। কিন্তু তাও আর বেশিদিন টিকলো কোথায়! গতবছরের ডিসেম্বর থেকে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় আবার কাজ হারাতে থাকে পারুল। এরমধ্যেই একে একে দুইটি কাজ হারায় পারুল। তবে এবার স্বামীর কাজ মোটামুটি চলছিলো। মাঝে একটি ফ্ল্যাটে কাজ শুরু করে পারুল। কিন্তু সমস্যার আর শেষ হলনা। মহাজনের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রিক্সা হারায় পারুলের স্বামী। সংসারের সব চাপ পড়ে পারুলের ওপর। সন্তানদের মুখে খাবার জোটাতে পারতোনা সে।
সঞ্চয়ের টাকা তো শেষই এবার তাদের করতে হয় ঋণ। ধারের টাকার ওপর এবার শুরু হয় জীবন। কেবল একটি ফ্ল্যাটের কাজের টাকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লো চারটি পেট। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবার আরেকটি কাজ পায় পারুল। কিন্তু স্বামীর বেকারত্ব যায়না।
সবচেয়ে দুর্বিষহ সময় আসে এই লকডাউনে। জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া এবারের কঠোর লকডাউনে পারুল আবার সব কাজ হারায়। স্বামী একটি দোকানে বসার কাজ নিয়েছিলো। সেই দোকানও বন্ধ। প্রথম লকডাউনে তারা উভয়ই বেকার থাকলেও তাদের সঞ্চয় দিয়ে মোটামুটি চলেছিল তাদের সংসার। কিন্তু এবার আর তা নেই। অন্যদিকে ঋণের টাকাও পরিশোধ করতে পারেনি পারুল। তবে পারুল যে বাসায় কাজ করতো সেই বাসা থেকে বেতন ছাড়াও কিছু সাহায্য পেয়েছিলো। সেই দিয়ে আর কয়দিন চলে সংসার! পারুল বলেছেন, ‘করোনার কারণে আমগোর একটা সুন্দর সংসার অভাবের সংসারে রূপ নিছে। একবেলা খাইতেই আমাদের এখন কষ্ট হয়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা না খাইয়াই দিন পার করে।’ করোনায় সামাজিক দূরত্ব মানার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এইদিক না খাইয়া দিন পার করতাসি আবার করোনা নিয়া ভাববো কেমনে। করোনায় না মরলেও লকডাউন না ছাড়লে না খাইয়া মরুম।’
গ্রামে কোন পৈতৃক সম্পত্তি না থাকায় গ্রামেও ফিরে যেতে পারেনি পারুলের পরিবার। এ ব্যাপারে তিনি জানান, ‘এইহানে কোন ছুট কাজের জন্য অনেক সময় ডাক পাই। সামান্য কিছু হইলেও আয় হয়। কিন্তু গ্রামে যাইয়া টাকা কই পামু। আবার যাইতে আইতেও খরচ বেশি।’ দেশ থেকে করোনা মহামারি একেবারে বিতাড়িত হবার অপেক্ষায় আছে পারুল। এই করোনা ভাইরাস তার জীবনে সুখ কেড়ে নিয়ে দিয়েছে দুর্দশার জীবন।
কাজ হারানের এই গল্প কেবল পারুলের নয়। পুরো দেশেই পারুলের মতো অনেক নারীই আছেন যারা লকডাউনের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। অর্থাভাবে অনাহারে পার করতে হচ্ছে তাদের দিন। বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ জরিপে দেখা যায়, ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের ৫৭ শতাংশের বেশি নারী গৃহকর্মী বেকার হয়েছেন। তারা আরো বলছে, গত বছর করোনা শুরুর পর গৃহকর্মীদের আয় করোনার আগের তুলনায় ৬১ ভাগ কমে গিয়েছিল। চলতি বছর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এই আয় এখনো করোনার আগের তুলনায় ১২ শতাংশ কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মীদের কর্মহীনতা পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বেকার হয়ে পড়া এই শ্রমশক্তিকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং বিশেষ উদ্যোগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা বড় একটি বিকল্প হতে পারে। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত। ত্রাণ ও বিনা সুদে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে তাদের দুর্দশা একটু লাঘব করা যাবে। কেবল সরকারই নয়, ধনী ব্যক্তিরাও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারেন। গরীব, বেকার, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ালেও তাদের দুঃখ একটু লাঘব হতো।