প্রাণের সম্ভাবনা শুক্রতে!
মহাবিশ্বে এই পৃথিবী ছাড়া কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব? তা খুঁজতে মানুষের চোখ বারবার মঙ্গলগ্রহে ছুটলেও খবর এসেছে শুক্র গ্রহ থেকে।পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের এই গ্রহটিতে মেঘে ফসফিন গ্যাস দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। শুক্র আমাদের পৃথিবীর নিকটতম গ্রহ হলেও শুক্রের আয়তন ও ভর পৃথিবীর কাছাকাছি হলেও শুক্রের বায়ুমণ্ডলের সাথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কোন মিল নেই। সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে জন্মের সময় শুক্র ও পৃথিবীর পরিবেশ হয়তো একই রকম ছিল। কিন্তু তারপর দুই গ্রহের বিবর্তন হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।
কোটি কোটি নক্ষত্রের মাঝে লক্ষ কোটি গ্রহের মধ্যে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এখনো প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। তবে মহাকাশবিজ্ঞানীদের অনেকেই ভিনগ্রহে প্রাণ থাকার ব্যাপারে আশাবাদী। মহাকাশে প্রাণের সন্ধানে এ পর্যন্ত অনেকগুলি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে অনেকগুলি স্যাটেলাইট। কল্পবিজ্ঞানে ভিনগ্রহের প্রাণীদের যেরকম বুদ্ধিমান পূর্ণাঙ্গ প্রাণী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে—তেমন প্রাণী খুঁজে পাবার আশা বিজ্ঞানীরা করেন না। কিন্তু কমপক্ষে কোন এককোষী আদি প্রাণীর সন্ধানও যদি পাওয়া যায় তাও অনেক। তাই প্রাণের উদ্ভব ঘটতে পারে এরকম কোন প্রাণ রাসায়নিক উপাদান খুঁজে পেলেই বিজ্ঞানীরা আনন্দিত হয়ে উঠেন। সম্প্রতি শুক্র গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা আছে এরকম প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
বৃটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী জেইন গ্রিভসের নেতৃত্বে শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদানের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। ২০১৭ সালে হাওয়াইয়ের জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল টেলিস্কোপের সাহায্যে শুক্রগ্রহের বায়ুমণ্ডলের মেঘের বর্ণালী বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, সেখানে প্রচুর ফসফিন গ্যাস আছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করেও একই ফল পেয়েছেন। তাদের গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফসফিন আছে এর চেয়ে হাজারগুণ কম।
প্রশ্ন হলো, ফসফিনের সাথে প্রাণের সম্পর্ক কী? এমন তো না যে ফসফিন এর আগে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতির মত বিশালাকৃতির গ্রহের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড গ্যাসীয় চাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রায় প্রচুর ফসফিন গ্যাস তৈরি হচ্ছে। শনি গ্রহেও পাওয়া গেছে এই গ্যাস। তবে শুক্র গ্রহে ফসফিন দেখতে পেয়ে বিজ্ঞানীরা এত উত্তেজিত কেন? শুক্র গ্রহের যেখানে এত বেশি পরিমাণ ফসফিন পাওয়া গেছে, সেই বিষাক্ত সালফিউরিক এসিড সমৃদ্ধ মেঘের আস্তরণের ওপরে এত বেশি ফসফিন এক সাথে থাকার একটিমাত্র কারণ রয়েছে। সে কারণটি হলো জৈব প্রাণের উপস্থিতি।
ফসফিন খুব সরল সাধারণ দুর্গন্ধযুক্ত একটা গ্যাস। ফসফরাসের একটি পরমাণু তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত থাকে। বৃহস্পতি বা শনির মত বড় বড় গ্রহে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে প্রাকৃতিকভাবে ফসফিন তৈরি হতে পারে। কিন্তু পৃথিবী বা শুক্রের মতো আয়তনের ছোট গ্রহের তাপ ও চাপ আপনাআপনি ফসফিন তৈরির উপযুক্ত নয়। পৃথিবীতে কলকারখানায় এই বিষাক্ত গ্যাস অনেক উৎপন্ন হয়। তাছাড়া কিছু সামুদ্রিক অণুজীব এবং কিছু অ্যানেরোবিক মাইক্রো অর্গানিজম– যেগুলি অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচে- সেগুলো জৈবপদ্ধতিতে ফসফিন তৈরি করে। ফসফিন গ্যাস খুব সহজেই বাতাসের অন্যান্য গ্যাসের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় অন্য অণুতে পরিণত হয়। শুক্রগ্রহে যে পরিমাণ ফসফিন পাওয়া গেছে—সে পরিমাণ ফসফিনের জন্য নিয়মিত জোগানদাতাদেরও থাকতে হবে সেখানে। ফসফিনের নিয়মিত জোগানদাতা হতে পারে অণুজীব।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মলিকুলার পদার্থবিদ কার্লা সোস-সিলভা বলেন, “আমাদের এই আবিষ্কারের ব্যাখ্যা যদি করতে হয়, তবে আমি সবার আগে বলব প্রাণ।এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যদি এটা ফসফিনই হয়, তবে তার মানে এটাই দাঁড়ায় যে এর পেছনে প্রাণ আছে। তার মানে আমরা একা নই।” তিনি আরো জানান বলেন, “শুক্রতে এখন হয়ত বাসযোগ্য নয়, তবে অনেক অনেক কাল আগে হয়ত এর পৃষ্ঠে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। হয়ত গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া এই গ্রহকে এখন অবাসযোগ্য করে তুলেছে।”
বিশাল এই মহাবিশ্বে মানুষের আবিষ্কারের পরিধি দিয়ে বিচার করলে পৃথিবী এখনও নিঃসঙ্গ এক গ্রহ। সৌরজগতের এই গ্রহটিতেই কেবল এখন অবধি প্রাণের সন্ধান মিলেছে। কোন জীবকে এর কারণ ধরেই এখন আবর্তিত হচ্ছে বিজ্ঞানীদের গবেষণা। সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে এমন কোনো প্রামাণ্য তথ্য এখনও মেলেনি। কিন্তু পৃথিবীতে ফসফিন গ্যাস উৎপাদনে ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকার কথা মাথায় রেখে তারা ভাবছেন। সুতারং শুক্র গ্রহেও তেমন কোনো অনুজীব থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।