ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তি!
একবার আইনস্টাইন কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হতে কেমন লাগে? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এর উত্তর আমার জানা নেই। আপনি নিকোলা টেসলা কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন!’ এক অবাক মানব নিকোলা টেসলা।
নিকোলা টেসলার জন্ম ১৮৫৬ সালে। তিনি জন্মসূত্রে সার্বিয়ান। কিন্তু পুরো শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ায়। এ কারণে সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া আজও টেসলাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে, বিতর্ক করে- তিনি আসলে কাদের? বিতর্কের মূল কারণ সেই সময় দুটো এলাকাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা পরে ভেঙ্গে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে পরিণত হয়। তার পিতা ছিলেন একজন যাজক। নানাও ছিলেন তাই। ৫ ভাই বোনের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ।
তার বাবার ইচ্ছে ছিল নিকোলা-ও বড় হয়ে প্রিস্ট হবে তার মত। ছোট থেকেই তাকে সেটা নিয়ে চাপ দিতেন। কিন্তু নিকোলা সেটা চাইতেন না। ১৮৬১-তে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন নিকোলা, শেখেন জার্মান ভাষা, গণিত আর ধর্মতত্ত্ব। ১৮৭০ সালে হাই স্কুলে পড়ছিলেন তিনি, যখন সেই ইন্টিগ্রেশনের ঘটনাটা ঘটে। তখনই তার আসল মেধাটা ধরা পড়ে। চার বছরের পড়া তিন বছরেই শেষ করে গ্র্যাজুয়েট করে ফেললেন তিনি ১৮৭৩ এ।
সে বছরই ফিরে গেলেন নিজের গ্রামে। এসে কলেরার প্রকোপে পড়লেন। খুব ভয়ংকর অবস্থা। নয় মাস ছিলেন শয্যাশায়ী। কয়েকবার মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। নিকোলার বাবা অসহায় হয়ে তাকে কথা দিলেন, সুস্থ হলে তাকে সবচেয়ে ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়তে পাঠাবেন। আর বলবেন না যাজক হতে। টেসলা সুস্থ হয়ে উঠলেন এক সময়।
১৮৭৪ সালে নিকোলা আর্মিতে ভর্তি হওয়া থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলেন। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরলেন। টেসলা পরে বলেছিলেন, প্রকৃতির সাথে এই নৈকট্যটা অনেক দরকার ছিল তার। বসে বসে মার্ক টোয়েন পড়তেন তিনি।
১৮৭৫ এ টেসলা ভর্তি হলেন অস্ট্রিয়ান পলিটেকনিকে। ফার্স্ট ইয়ারে তিনি একটা লেকচারও মিস করেন নি। সবগুলোতে ছিল হায়েস্ট গ্রেড। ডিনের থেকে লেটার পেয়েছিলেন তার বাবা, “আপনার ছেলে প্রথম শ্রেণীর স্টার।” প্রতিদিন রাত ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত টানা খাটতেন তিনি। কোন ছুটির দিনও বিশ্রাম নিতেন না।
১৮৭৯ তে বাবা মারা যাবার পর বাবার পুরনো চিঠি ঘাটতে গিয়ে দেখলেন সেখানে তার প্রফেসরদের কাছ থেকে চিঠি আছে, “আপনার ছেলেকে এখুনি স্কুল থেকে সরিয়ে নিন। নাহলে খাটতে খাটতে মারাই যাবে।” সেকেন্ড ইয়ারে “কমুটেটর দরকার কি দরকার না” সেটা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রফেসরের সাথে। সে বছরই জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন নিকোলা আর স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায় তার। থার্ড ইয়ারে তিনি তার সব সম্পদ জুয়ায় উড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। কিন্তু জুয়া খেলেই সব আবার earn back করেন। পরে তার বিলিয়ার্ড খেলার নেশা ধরল।
এক্সাম টাইম আসার পর, টেসলা আবিষ্কার করলেন তিনি কিছুই পড়েন নি। তিনি পিএল বাড়াতে চাইলেন। কিন্তু তার দাবি অগ্রাহ্য করা হল। তিনি গ্র্যাজুয়েট করতেই পারলেন না। লাস্ট সেমিস্টারের কোন গ্রেডই তার ভাগ্যে জুটল না। হয়ে গেলেন একজন ড্রপ-আউট।
১৮৭৮ এর ডিসেম্বরে টেসলা চলে গেলেন। নিজের পরিবারের সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তারা যেন টের না পায় যে টেসলা এখন একজন ড্রপ আউট। স্লোভেনিয়াতে চলে গেলেন তিনি, সেখানে মাসে ৬০ ফ্লোরিন এর বিনিময়ে ড্রাফটসম্যান এর কাজ করতেন, আর বাকি সময়টা কার্ড খেলে কাটাতেন রাস্তায় রাস্তায় মানুষের সাথে।
৭৯ সালের মার্চে তার বাবা তাকে সেখানে খুঁজে পেলেন, হাত জোড় করলেন বাড়ি ফিরতে, কিন্তু নিকোলা ফিরলেন না। এ সময়টা তিনি নার্ভাস ব্রেকডাউনে পড়েন।৭৯ সালেই তিনি ফিরে আসেন আর বাবাও মারা যায় স্ট্রোক করে। সেখানে তার পুরনো স্কুলে পড়াতে লাগলেন টেসলা।
১৮৮০ সালে চাচাদের টাকায় প্রাগ-এ পড়তে যান টেসলা। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ভার্সিটিতে রেজিস্ট্রেশন টাইম শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, ভার্সিটির যে যোগ্যতা দরকার ছিল যে গ্রিক আর চেক ভাষা জানতে হবে, তিনি এ দুটো তখনও পারতেন না। ৮১ সালে বুডাপেস্টে যান তিনি। সেখানে এক টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে কাজ করতে লাগলেন। এখানেই টেসলা তার প্রথম সায়েন্টিফিক কাজ করেন, তিনি টেলিফোনের অ্যামপ্লিফায়ার পারফেক্ট করে তুলেন। কিন্তু কোনদিন সেটার পেটেন্ট নেন নি।
৮৪ সালে থমাস আল্ভা এডিসনের কোম্পানিতে কাজ করতে যান, স্বয়ং এডিসন তাকে হায়ার করেন নিউ ইয়র্কে। প্রথম প্রথম তার কাজ ছিল সিম্পল ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর এরপর ধীরে ধীরে কঠিন সব প্রব্লেম আসতে থাকে। তার কাজ দেয়া হল ডিসি জেনারেটর রিডিজাইন করা। ১৮৮৫ সালে টেসলা বললেন, “আমি এটা আরো ভাল করে বানাতে পারব।” এডিসন বললেন, “পারলে তোমাকে ৫০ হাজার ডলার দেব।” মাসের পর মাস কাজ করার পর টেসলা আসলেই কাজটা পারলেন। এডিসনকে তখন তিনি পেমেন্ট দিতে বললেন।
হাসিমুখে এডিসনের উত্তর ছিল, “আরে টেসলা, তুমি দেখি আমেরিকান হিউমর বোঝোই না।” টেসলার বেতন কেবল ১৮ডলার/উইক থেকে ২৮ ডলার করে দিলেন এডিসন, এই ছিল তার পুরস্কার। কিন্তু টেসলা সেটা নিতে অস্বীকার করলেন। তিনি কোম্পানি থেকে রিজাইন করলেন।
১৮৮৬তে তিনি নিজের “টেসলা ইলেক্ট্রিক লাইট অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং” কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে তিনি ডায়নামো ইলেকট্রিক মেশিন কমুটেটর বানালেন, যেটা ছিল তার প্রথম পেটেন্ট। কিন্তু টেসলার নতুন নতুন জিনিসে ইনভেস্টররা আগ্রহ পেতেন না। টেসলা হয়ে পড়লেন কপর্দকহীন। এক পর্যায়ে তার পেটেন্টগুলোও হাতছাড়া হয়ে যায়। টাকার জন্য তিনি রিপেয়ার জব করে বেড়ালেন, এমন কি দিনে দুই ডলারের বিনিময়ে গর্ত খোঁড়ার কাজও করলেন। ১৮৮৬/৮৭ সালের সেই শীতকালে তিনি ভাবছিলেন, “কি লাভ হল আমার এত পড়াশুনা করে!?”
এরপর দুইজন ব্যবসায়ীয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার পরেই জীবন পরিবর্তন হয়ে গেল এই জাদুকরের। জীবনের একটা বিশাল সুই গাথা তো হল এবার আসি তার অর্জনে। বৈদ্যুতিক জেনারেটর (মূলনীতি মাইকেল ফ্যারাডের হলেও ব্যবহারিক আবিষ্কার টেসলার)
*রেডিও
*রিমোট কন্ট্রোল
*স্পার্ক প্লাগ
*রোবট
*ফ্লুরোসেন্ট বাতি ( ক্রেডিট পরে ‘এডিসন’ নিয়ে নেন)
*টেসলা কয়েল (টিভি, রেডিও দুটোরই অপরিহার্য অংশ এবং আরও অনেক কিছু যা এই বিংশ শতাব্দীতে আপনার জীবনকে পুরোই বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে টেসলার শত্রুতার বিষয়টা কল্পনা করাটা হয়ত বেশ আনন্দদায়ক মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, টেসলা তার এসি কারেন্ট ইন্ডাকশান মোটর এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছা ত্যাগের পূর্বেই তারা একে অপরকে ডিসি- কারেন্ট জেনারেটর ডিজাইনে সাহায্য করেছিলেন। সম্ভবত তাদের সম্পর্ককে ‘ব্যবসায়িক- প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে বলা যেতে পারে।
টেসলার জীবনে কিছু মজার ঘটনাও রয়েছে। লোকটি নিছক রসিক ও ছিল বটে। বিদ্যুৎ তৈরি করতে গিয়ে টেসলা একদিন এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেন, যেটি চালু করলেই ম্যানহাটনে তার বাসা এবং প্রতিবেশীদের বাসাও কেঁপে উঠত। টেসলা ভাবলেন, তিনি সম্ভবত ‘ভূমিকম্প যন্ত্র’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। পরে বুঝতে পারলেন তিনি আসলে একটা উচ্চ কম্পাঙ্কের দোলক (High Frequency Oscillator) তৈরি করে ফেলেছেন। এই দোলক দিয়ে মার্ক টোয়েনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও ফেলেছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান। টেসলা দাবী করতেন রাতে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুম ই তার জন্য যথেষ্ট। তবে এর কারণ অস্পষ্ট। তিনি আসলেই ২ ঘণ্টা ঘুমাতেন কিংবা এর বেশি ঘুমাতে পারতেন কি-না; এ বিষয়ে সঠিক কিছু জানা যায়নি।
টেসলা সংখ্যা ৩ এর ব্যাপারে অতি মাত্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। এবং রাতের খাবারের পূর্বে ১৮টি (৩ দ্বারা বিভাজ্য) রুমাল দ্বারা তার ডাইনিং রুম পরিষ্কার করতেন। এছাড়া তিনি বৃত্তাকার বস্তু, গহনা এবং চুল স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতেন। বিজ্ঞানী টেসলার স্মরণশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে তিনি পুরো বইটিই বিশদভাবে মনে রাখতে পারতেন। প্রখর কল্পনা শক্তির কারণে ছোটবেলায় প্রায়ই তিনি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখতেন ।
টেসলা মারা যাওয়ার পর অফিস অব এলিয়েন প্রপার্টি(The Office of Alien Property) তার সমস্ত ব্যবহার্য জিনিস এবং নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তীতে এর বেশিরভাগই তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং কিছু জিনিস বেলগ্রেডে টেসলা যাদুঘরে দান করা হয়। মজায় ব্যাপার হল, টেসলা ১৯৪৩ সালে মারা গেলেও এখনও তার কিছু ব্যক্তিগত নথিপত্র মার্কিন সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত অবস্থায় আছে। এই অদ্ভুত মানবটি ৭ জানুয়ারি ১৯৪৩ এ ৮৬ বছর বয়সে মারা যান।
টেসলা প্রাকৃতিক সম্পদের দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জ্বালানীর সমর্থক ছিলেন। এছাড়াও তিনি কীভাবে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর থেকে চাপ কমানো যায় সেই বিষয়েও বহু গবেষণা করেছেন। জিনের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম বীজ তৈরি করার মতোও সফল গবেষণাও তার রয়েছে।
আপনার মুঠোফোনে যে জিনিসটা ছাড়া কল্পনাই করতে পারেন না। সেই ওয়াইফাই এর ধারণাও তিনি দিয়ে গেছেন আরও কয়েক যুগ আগে। টেসলা মানবজীবন উন্নত করার ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর মত তিনি সারাদিন শুধু গবেষণা নিয়েই পড়ে থাকতেন উপরন্তু আবিষ্কারের আর্থিক বা ব্যবসায়িক দিক নিয়ে ভাবতেন না। এ কারণে তার অনেক উদ্ভাবন এবং সামাজিক অবদান থাকা সত্ত্বেও শেষ জীবন তিনি চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন।
টেসলা ভেহিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ এই বলেন কিংবা মানব টেসলাই বলেন সবসময়েই শীর্ষে ছিল টেসলা নামটি। আধুনিক সময়ে যা কিছুর কারণে আপনার জীবন হয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যময় এর পিছনে একটি বিজ্ঞান পাগল মানুষের এই অবদান। তবে আমরা অনেকেই তাকে চিনি না। কেননা তিনি গ্যালিলিও বা আইন্সটাইনের মত বিশ্বের কাছে পরিচিত নন৷ এই রহস্যের কারণ কি কখনো আমরা জানতে পারবো? নাকি সবই অগোচরে থেকে যাবে আমেরিকান আবিষ্কারকদের অন্তরালে।