Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

আজও অনেকের মনে পিরামিড নিয়ে নানান প্রশ্ন জাগে। মানবসভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় নিদর্শন হল পিরামিড। এর সুবিশাল উচ্চতা ও শৈলীর সামনে দাঁড়ালে বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সারা বিশ্বের কাছে মিশরের পরিচিতি আছে তাদের পিরামিড গুলোর জন্য। প্রাচীন কালের পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের মধ্যে পিরামিডই সবচেয়ে পুরনো এবং অনেকাংশে অক্ষত। মিশরের নির্মিত প্রাচীন সব পিরামিড গুলো নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত ।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সভ্যতাগুলোর একটি গড়ে উঠেছিল মিশরে। মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম পিরামিড আকৃতির স্থাপনা তৈরি করেছিল। মিশরের প্রাচীনতম পিরামিডগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে মেমফিসের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সাক্কারায়। প্রথম দিকের ইতিহাস অনুসারে মিশরীয় রাজবংশের মানুষদের মৃত্যুর পরে বেঞ্চ-এর মত কাঠামোতে চির শায়িত করা হত ।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

 

মিশরের রহস্যময় পিরামিডের নির্মাণ ও পিরামিডের ইতিহাস নিয়ে বহু কাহিনী ও কথা প্রচলিত আছে। মিশরীয়রা মানুষকে কবরস্থ করার জন্য মৃত দেহকে মমিতে পরিণত করত। মৃতদেহকে মমি করার পর, রাখা হত ত্রিভুজাকৃতি মকবরা তৈরি করে। মিশরীয় ভাষায় এই মকবরা হল পিরামিড (Pyramid)।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

 

পিরামিডে নিয়ে মানুষের মনে যেন রহস্যের শেষ নেই। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মমি করত তারা। প্রাচীনকালে মিশরের লোকেরা মিশরের রাজা, মানে যাকে আমরা ফারাও বলেই বেশি চিনি। ফারাও এর মধ্যে কারোও মৃত্যু হলে, মিশরের লোকেরা ফারাওকে কবরস্থ করার আগে তার মৃত শরীরকে পচনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করত। এই মমি করার প্রক্রিয়া ০২টি মুখ্য কৌশলে করা হত- অভ্যন্তরীণ মমি ক্রিয়া ও বাহ্যিক মমি ক্রিয়া। অভ্যন্তরীণ মমিক্রিয়ার জন্য, সর্বপ্রথম মৃত ব্যক্তির নাড়ি, ভুঁড়ি সহ বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন-কিডনি, ব্রেন, লিভার, যকৃৎ ইত্যাদি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি বার করে নেওয়া হত। মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বলতে শুধু হৃদযন্ত্র বা হৃৎপিণ্ড কে শরীরের ভিতরে রেখে দেওয়া হত। মিশরীয় লোকেদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের হৃৎপিণ্ডে মানে হৃদয়ে মানুষের আত্মার বাসস্থান। তাই তারা মৃতদেহের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটিকে অক্ষত রেখে, মৃত শরীরে বিশেষ পচন রোধক মসলা মাখিয়ে মমি করে রাখত।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

 

অভ্যন্তরীণ মমি করার পক্রিয়া শেষ হলে, শুরু হতো বাহ্যিক মমি করার পক্রিয়া। মৃতদেহে বাহ্যিক মমি করণের প্রক্রিয়ায়, মৃতদেহের বাহ্যিক শরীরে মসলা মাখানোর পর, পুরো মৃতদেহকে লম্বায় ০১.৫ কিমি কাছাকাছি পুরো ব্যান্ডেজ দিয়ে মৃত দেহকে জড়িয়ে বেঁধে ফেলা হত। এরপর ব্যান্ডেজ বাঁধার পক্রিয়া শেষ হলে লাইলেন নামের একপ্রকার দড়ি দিয়ে পুরো মমিকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলা হতো। মৃতদেহ ভালোভাবে বাঁধা হয়ে গেলে, মমি করা মৃতদেহকে বড়ো মকবরার মধ্যে রাখা হত সাথে ফারাও এর অতি প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন- খাট, বিছানা, মদিরা, অলংকার সামগ্রী এবং রাজার যাবতীয় প্রিয় দ্রব্য সামগ্রী গুলি রাজার মমির সাথে কবরস্থ করা হত, ফারাও এর পুনঃ জন্ম প্রাপ্তির আসায়। মিশরীয় সংস্কৃতির এই চিরাচরিত প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

 

মিশরীয় পিরামিড হল মিশরে অবস্থিত প্রাচীন পিরামিড- আকৃতির প্রস্তর নির্মিত স্থাপনাসমূহ। মিশরীয় পিরামিডগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত পিরামিডগুলি দেখা যায় কায়রো শহরের উপকণ্ঠে গিজায়। গিজার বেশ কয়েকটি স্থাপনাকে বিশ্বের অন্যতম বৃহদাকার স্থাপনা বলে মনে করা হয়। মিশরে ছোটবড় ৭৫টি পিরামিড আছে। সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় হচ্ছে গিজা'র পিরামিড যা খুফু'র পিরামিড হিসেবে পরিচিত। ফারাও খুফুর পিরামিড আকারে সবচেয়ে বড়, তার নাম গ্রেট পিরামিড। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লাখ। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। খুফু’র পিরামিডের ভেতরে কোন চিত্রলিপি পাওয়া যায় নি। খুফুর জন্য নির্মিত গিজার পিরামিডটির পাশে তার রাণীদের জন্য আরো তিনটি পিরামিড নির্মিত হয়। শহরের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলে অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে গিজা পিরামিড কমপ্লেক্স।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

ইতিহাস থেকে আমরা আরও জানতে পারি, গিজার গ্রেট পিরামিড তৈরিতে প্রায় আড়াই মিলিয়ন পাথরের ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে যার একেকটির ওজন ২-৭০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হত। ১৩ একর জায়গা জুড়ে পিরামিডটি বিস্তৃত। নির্মাণের সময় গিজার পিরামিডের বাইরের আবরণ এক বিশেষ পাথর দ্বারা আবৃত করা হয়। ৪৫০০ বছরের ঝড়, দুর্যোগ সহ্য করে এখনও টিকে আছে। ইজিপ্টের এই পিরামিড বিখ্যাত ও রহস্যময় হওয়ার পিছনে অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আসুন জেনে নেয়া যাক মিশরের সেই পিরামিড রহস্যময় হওয়ার কারণ।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

ইজিপ্টের গিজা শহরে অবস্থিত ০৩ টি পিরামিড হল বিশ্বের সবথেকে প্রাচীন এবং আকার ও আয়তনে বড়। যার জন্য মিশরের পিরামিডকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায় শীর্ষে রাখা হয়েছে। ইজিপ্টের গিজা শহরে অবস্থিত ৪৮১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মিশরের রহস্যময় পিরামিডকে, সবাই খুফুর পিরামিড বলে জানে। বলা হয় ফারাও খুফু মারা যাওয়ার আগে, খুফুর বাবা খাফর ফারাও এর পিরামিডের পাশে খুফু তার পিরামিড তৈরি করে সমাধিস্থ করার আদেশ দিয়েছিলেন। পরে রাজা খুফুর মৃত্যু হলে তার বাবার খাফর এর পিরামিডের পাশে খুফুর পিরামিড নির্মাণ করা হয়। খুফুর পিরামিডের পাশে, কিছুটা দূরেই রয়েছে এক বিশালাকার পশুর শরীর বিশিষ্ট, মানব মুণ্ড যুক্ত বিশালাকার এক মূর্তি। এই মূর্তিটিকে Sphinx বলা হয়। Sphinx কে রাজা খাফর এর মূর্তির অংশ হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। Sphinx মূর্তিটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে দূর থেকে পর্যটকদের মনে হয় Sphinx হল রাজা খাফর পিরামিডের অত্যন্ত সজাগ প্রহরী। যে সর্বদা ফারাও খাফর এর পিরামিডকে পাহারা দিয়ে শত্রু পক্ষের নজর থেকে আগলে রাখছে। বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মতানুযায়ী Sphinx এর মানুষের মুণ্ডের যে চেহারার মধ্যে দিয়ে, ফ্যারও খাফর এর চেহারাকে তুলে ধরা হয়েছে।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

গিজার তৃতীয় পিরামিডটি আর ০২ টি পিরামিড থেকে আকারে ছোট। এই ছোটো পিরামিডটাকে মেনকায়ার এর পিরামিড বলা হয়ে থাকে। প্রত্নবিদদের মতে মেনকায়ার হল রাজা খাফর এর উত্তরাধিকারী। ইজিপ্ট এর গিজা শহরে অবস্থিত পিরামিড হল মানব দ্বারা নির্মিত পৃথিবীর প্রথম আশ্চর্যতম জিনিস। কালের প্রহরে সময়ের সাথে, সাথে সবকিছু বিলীন হয়ে গেলেও একমাত্র মিশরের পিরামিড সমস্ত রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্পের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মিশরের পিরামিড রহস্য নিয়ে তার প্রাচীনতার প্রমাণ দিচ্ছে। কালের নিয়মে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেলেও মিশরের রহস্যময় পিরামিড একই জায়গায়,পাহাড়ের ন্যায় মৃত্যুঞ্জয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

 

এই পিরামিড গুলো এতটা সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ নিয়ে নির্মিত হয়েছে, দেখে মনে হবে বর্তমান সময়ের কোন কারিগর সেখানে সময় পরিভ্রমণ করে গিয়ে তৈরি করে দিয়ে আসছে । এদের সম্মুখভাগ প্রায়ই বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেয়া থাকত, যা জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত গুরুত্ব বহন করত। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মিশরে ১৩৮টি পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির অধিকাংশই নির্মিত হয় প্রাচীন ও মধ্যকালীন ফারাওদের রাজত্বকালে তাদের ও তাদের পত্নীদের সমাধিসৌধ হিসেবে।

 

000

মিশরীয়রা আজও একটি বিষয়কে রহস্যের চাদরে ঢেকে রেখেছে সেটি হল কীভাবে পিরামিড তৈরি হল। এ বিষয়ে কোথাও স্পষ্ট করে কোন প্রমাণ তারা রেখে যায়নি। সাধারণ মানুষের পক্ষে কি ১৪৫ মিটার উচ্চতায় কয়েক টন ওজনের পাথর উঠানো সম্ভব ছিল? নাকি সেগুলো ছিল ভিনগ্রহের প্রাণীদের কাজ। তাহলে কারা এই বা পিরামিড তৈরি করে রহস্যের জাল ফেলে গেল? অনেকেই বলেন ভিনগ্রহ বাসীরা এটা তৈরি করেছিল অথবা হাজার হাজার মিশরীয় দাস বছরের পর বছর টন টন পাথর কেটে এনে এই পিরামিডগুলো বানিয়েছিল।

 

রহস্যের বন্দী জালে পিরামিড 

বর্তমানকালের বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন, হাজার হাজার মানুষ মিলে বছরের পর বছর এত কষ্ট সহ্য করে পিরামিডগুলো বানিয়েছিল। ভিনগ্রহ বাসীরা পিরামিড তৈরি করেছিল এর তেমন শক্ত প্রমাণ মেলেনি এখনো। ফারাওদের সময়ে হাজার হাজার ইহুদী মিশরে দাস হিসাবে ছিল। তারা ছিল অত্যাচারিত ও অবহেলিত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই দাসদের দিয়েই পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল। তবে এর রহস্যের জাল হয়ত থেকেই যাবে সবার মনে। কারণ ইজিপ্ট সরকার ও এর রহস্য উন্মোচন করে তাদের দেশের পর্যটক ব্যবস্থার ক্ষতি করতে চাইবে না।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ