সকল দায়িত্ব কি কেবল বাবাদেরই?
দেশজুড়ে হরেক রকম আয়োজনে বাবা দিবস পালিত হয়েছে। বিশেষত বাবা দিবস উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই নিজের বাবার সাথে ছবি শেয়ার করছেন, কেও কেও ভিডিও বার্তা ও নানা ডিজিটাল কন্টেন্ট এর মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বহুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এইবার অনেকের জন্মদাতা পিতার পাশাপাশি শ্বশুরের ছবিও একত্রে শেয়ারের মাধ্যমে "বাবা"দের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করতে দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে "বাবা" মানেই পরিবারের কর্তা এবং অন্যতম এক দায়িত্ববান মানুষ। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন – “পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।” বাংলার সংস্কৃতিতে পিতৃছায়া তথা পরিবারে বাবার উপস্থিতিকে বটগাছের ছায়ার সাথে তুলনা করা হয়। প্রখর রোদে তৃপ্তিদায়ক অন্যতম এক জায়গা বটতলা। তেমনি সন্তান মোটাদাগে পরিবারের সকলের কাছেই হাজারো সমস্যার সমাধান খুঁজে দিতে জানা এক ব্যক্তির হলেন বাবা। বাংলাদেশের সাহিত্য মতে, পরিবারের কন্যাশিশুদের কাছে বাবা মানেই অন্যতম ভরসার এক জায়গা। বাবারা নিজেদের চেয়ে পরিবারের জন্য বেশি ভাবে। অনেক উপন্যাসেই বলা হয়, মেয়েরা নাকি বাবাদের রাজকন্যা। তাই স্বভাবতই রাজকন্যাদের জন্যে বাবারা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করতে সচরাচর কার্পণ্য করে না। তবে এই ভালোবাসার মাঝেও বাবারা "সমাজ ব্যবস্থার" বেড়াজালে অলিখিতভাবে নানা বিড়ম্বনার শিকার হন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে ?
সমাজ সূক্ষ্মভাবে বাবাদের দায়িত্ব অর্পণ করে পরিবারের সকলের চাহিদা মেটাবার। প্রতি উৎসবে পরিবারের সকল সদস্যদের নতুন জামা এলেও কিভাবে যেন বাবাদের প্রতি ঈদ কিংবা পুজোয় নতুন জামা কেনা হয়ে উঠে না। সন্তানের বেড়ে ওঠায় পিতা-মাতা উভয়েরই গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। হরহামেশাই শোনা যায় যে, 'সন্তানদের অর্জনে নাম হয় বাবার, এবং সন্তান বিপথগামী হলে দোষ আসে মায়ের ওপর'। প্রচলিত এ বাক্যের ভাবার্থ যদিও পুরোপুরি খারিজ করা যায় না, তবে এর মাঝেও পরিবারে বাবা-মায়ের নিজেকে ব্যক্তি বিশেষ হিসেবে সকল আবেগ প্রকাশ করার বেলায় বিরাট পার্থক্য দেখা যায়।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাবা "হেড অফ দা ফ্যামিলি" নামে পরিচিত। অর্থাৎ বাবা পরিবারের মূল হর্তাকর্তা। বাবারা চাইলেই সন্তানদের শাসন করতে পারে; সন্তানদের বাড়ি ফেরার সময় কিংবা বাড়ি থেকে বাহিরে যাওয়ার সময় সবকিছুই অলিখিতভাবে অদ্ভুতভাবেই বাবাদের মর্জি মোতাবেক গড়ে উঠে। মায়েদের যে শাসন সন্তানদের কাছে খুবই খেলো, সেই একই কথা বাবাদের কণ্ঠে সন্তানদের কাছে জমের বাক্যের সমতুল্য ও হয়ে যায় কখনো কখনো। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, দেশের অধিকাংশ পরিবারেই বাবাদের সাথে সন্তানদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব মায়েদের তুলনায় অনেকাংশে বেশি থাকে। তাই মায়েরা চাইলেই সন্তানদের কাছ থেকে যেমন বন্ধুর মতো নানা বিষয়ে জানতে পারে তেমনি নিজের নানা সুখ-দুঃখের গল্পও জানাতে পারে। বাবারা এক্ষেত্রে একটা সময় একাকীত্বে ভোগে। বাবারা কন্যা সন্তানদের রাজকুমারীর মতো দেখলেও কেন যেন একটা বয়সের পর বাবাদের রাজকন্যারা নিজের মায়েদের অন্যতম ভালো বন্ধু হয়ে যায়। তখন আর ছোট বেলার মতো রাজকন্যারা তাদের বাবাদের সাথে দিনের শুরু কিংবা শেষে গল্প করার অপেক্ষায় থাকে না। ছেলেশিশুরাও একটা বয়স পরে পরিবার থেকে দূরে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। তখন পঁচিশোর্ধ যুবকের অন্যতম ভালো বন্ধু বাবা একটা বয়সের পরে আর তেমন বন্ধু থাকে না। মায়েদের কান্না বেশিরভাগ সন্তানদের কাছেই পরিচিত, তবে বাবাদের কান্না করার স্বাধীনতাটাই সমাজে কেন যেন বিশেষভাবে অদৃশ্য।
মেয়েদের উচ্চশিক্ষিতা হয়ে ওঠা কিংবা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের বাবার উদার-ইতিবাচক চিন্তাভাবনার মানুষ হওয়া অনেক প্রয়োজনীয়, কেননা আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। একবিংশ শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের নানামুখী উন্নয়ন ঘটেছে। নারীরা আজ স্বাবলম্বী হচ্ছে। তবে আজো নিজের মেয়ের উপার্জন গ্রহণকে অনেক বাবারাই স্বস্তিকর মনে করে না। সমাজ আজোও শেখায় যে – 'বাবা হয়ে মেয়ের বেড়ে ওঠা ও বিয়ের আয়োজন করাটা দায়িত্ব।' তবে মেয়ের উপার্জনে নির্ভর করে বেঁচে থাকাটা তেমন স্বস্তির নয়। আমাদের সমাজ আজ শেখাচ্ছে- পরিবারে ছেলে-মেয়ে উভয় সন্তানকেই একই দাড়ি পাল্লায় মেপে লায়েক হবার সুযোগ তৈরি করতে। তবে আজো অধিকাংশ পরিবারে কেবল ছেলের উপার্জনে পরিবারের ভরণপোষণকে ইতিবাচকতার সহিত গ্রহণ করা হয়। কন্যা সন্তানদের উপার্জনে পরিবারের ভরণপোষণ এখনো তেমন ভালো চোখে দেখে না অনেক পরিবারই। তাই ছেলে বিয়ের পর নবদম্পতিদের একক পরিবারের ছেলের (স্বামী) বাবা-মায়ের দীর্ঘকালীন বসবাস করাটা সমাজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। তবে মেয়ের বিয়ের পর মেয়ের (স্ত্রী) মা-বাবাদের নবদম্পতির বাড়িতে বসবাস সমাজ ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে না। সহস্র বছর ধরে নারীরা বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়িকে "বাবা-মা" সম্বোধন করে একত্রে বসবাস করে আসলেও পুরুষরা আজোও নিজের সহধর্মিণীর পিতা-মাতাদের নিজের বাবা-মায়ের মতোই গ্রহণ করে একই সংসারে বসবাসের মানসিকতা গড়ে তুলতে পারে নি। তাই আজো বাবারা নিজের রাজকন্যাদের ধুমধাম করে বিয়ে আয়োজন করে গুরু দায়িত্ব পালন করলেও,সকল রাজকন্যারা নিজেদের মা-বাবার বৃদ্ধ সময়ের দেখভাল করার দায়িত্ব নেবার সুযোগ পায় না।