‘ধর্ষণ’ অপরাধ, তবে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ কেন নয়?
সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটমান সকল অপরাধের মধ্যে নিঃসন্দেহে ধর্ষণ অন্যতম নিন্দনীয় এক অপরাধ। তাইতো বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে রয়েছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন। কখনো আইন থমকে গেলে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে রাজপথ। তবে বৈবাহিক ধর্ষণের বেলায় সব কেন নিশ্চুপ?
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীরা নিজেদের স্ত্রীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দেখে। যাকে যখন খুশি, যেভাবে খুশি ভোগ-দখল করা যায়। তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই বৈবাহিক ধর্ষণের মাধ্যমে। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এই শব্দটি হাস্যরসাত্মক বলেই মনে হবে। অনেকে আবার জানেনই না 'বৈবাহিক ধর্ষণ' মানে আসলে কি?
বৈবাহিক ধর্ষণ বলতে স্বামী কর্তৃক এমন আচরণকে বুঝায় যেখানে স্বামী তার স্ত্রীর সম্মতিব্যতীত এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। স্বামীরা ধরে নেয় এটি তাদের বৈবাহিক অধিকার। সজ্ঞা জেনেও হয়তোবা অনেকে হেসেই উড়িয়ে দিবেন। কারণ পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। স্ত্রীর উপর আধিপত্য বিস্তার যেন তাদের বৈবাহিক জীবনের লক্ষ্য।
বেশিরভাগ পুরুষই এ ব্যাপারটিকে ধর্ষণ বলে মানতে একদমই নারাজ। এমনকি অনেক মহিলাও এটাকে ধর্ষণ হিসেবে মেনে নিবেন না। আর এর পেছনের কারণ ছোটবেলা থেকে আমাদের সুস্থ মস্তিষ্কে কিছু অসুস্থ বীজ বপন করে মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের স্বামী ভক্ত হওয়ার ট্রেনিং দেয়া হয়।
২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, চীন, ইন্দোনেশিয়ার ২৪% স্বামীরা তাদের স্ত্রীর সাথে জোরপূর্বক শারীরিকভাবে মিলিত হয় যেখানে কিনা তারা স্ত্রীর সম্মতি নেয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। এর মধ্যে ৩৮% পুরুষ স্ত্রীদেরকে শাস্তি প্রদান করতে জোরপূর্বক ভাবে মিলিত হয়। জাতিসংঘ ১০০০০ এর অধিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের উপর এ জরিপ চালায়। ২০১১ সালে জাতিসংঘ ১২০০০ মহিলার অংশগ্রহণে একটি জরিপ চালায়। যেখানে উঠে আসে ৮৭% বিবাহিত মহিলা বৈবাহিক ধর্ষণের কথা স্বীকার করে ।
বাংলাদেশে দণ্ডবিধি ১৮৬০’র ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া আছে এবং ৩৭৬ ধারায় এর শাস্তির বিধান উল্লেখ করা আছে। কিন্তু হতাশাজনক বিষয় দেশের নারীরা প্রতিনিয়ত বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকার হলেও এ সংক্রান্ত কোন আইন এখনো প্রণয়ন করতে পারেনি সরকার।
ধর্ষণ সংক্রান্ত ধারা দণ্ডবিধি ১৮৬০’র ৩৭৫, ৩৭৬ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’র ধারা ৯ এর কোথাও বৈবাহিক ধর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয় নি। বরং দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে বৈবাহিক ধর্ষণ ব্যাপারটাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে ৫ রকম উপাদানের কথা বলা হয়েছে। একটা দৃশ্যে বলা আছে একজন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় যার বয়স কিনা ১৩ বছরের কম না সেই ক্ষেত্রে তা কখনো ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। সুতরাং এখানে ১৩ বা তার অধিক বয়সের স্ত্রীর সাথে যেকোন পরিস্থিতিতে এমনকি সম্মতি ব্যতীত সহবাসকেও ধর্ষণ বলে গণ্য করা হচ্ছে না।
আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ বিবাহ করার মাধ্যমে শারীরিকভাবে মিলিত হবার বৈধতা পায় এটা যেমন ঠিক তেমনি নারীর ইচ্ছা -অনিচ্ছারও মূল্য রয়েছে। জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ এবং নির্যাতনের কাতারেই পরে, হোক সে আইনত স্বামী। প্রতিটি নারী একজন মানুষ। প্রতিটি মানুষেরই যার যার মানবাধিকার রয়েছে।
কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে আমাদের দেশের আইনের এই নিশ্চুপ অবস্থান স্বেচ্ছাচারী, প্রতিশোধ পরায়ণ পুরুষদের সাহস কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলছে। দিনের পর দিন নারীর প্রতি নির্যাতন আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর ভবিষ্যৎ ফলাফল যে খুব একটা সুবিধার হবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
কিন্তু দিনশেষে শুধু আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কি এ অপরাধ ঠেকানো সম্ভব? শুধু আইন নয় পরিবর্তন দরকার আমাদের মানসিকতার, আমাদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের।