সুভামনির গল্প
করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর থেকে অনেকেই অনলাইন কেনাকাটায় ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু খুব সহজে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার এই অনলাইন পণ্যের প্রতি অনেকের ক্ষোভ তৈরি হয়, যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। চটকদার বিজ্ঞাপন আর প্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। ঠকতে থাকেন। খাঁটি পণ্যের সন্ধান মেলে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের পাল্লায় পড়ে অনেকেই অনলাইন কেনাকাটার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এরকম অবিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে সুভামনি তার উদ্যোগ নিয়ে। এই উদ্যোগ থেকে গত ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে অনলাইন পণ্যের জন্য একটি ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করে সুভামনি। শুরু করে অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের সহযোগিতা।
সুভামনি যশোর জেলার, শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা। মিরপুর ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর বিয়ের সুবাদে পাড়ি জমান যশোরের প্রত্যন্ত এলাকায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও পড়াশোনা চালিয়ে যান, যশোরের ঝিকরগাছা কেএমএইএস মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন যশোরের শার্শা উপজেলার ডা. আফিল উদ্দিন কলেজে। সাংসারিক আর পড়ালেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে, অন্যদের দৃষ্টান্ত হিসেবে।
করোনাকাল সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, পড়ালেখা তেমন নেই। এসময় ঘরে শুধু অলস বসে না থেকে ঘরে থেকেই ব্যবসা করলেন দেশজুড়ে। সময়ের পরিক্রমায় সুভামনি হয়ে ওঠেন মার্চেন্ট কিংবা পপুলার গার্ল হিসেবে। ক্যাম্পাসের ছোট বড় যে কেউ দেখলেই মার্চেন্ট বলে ডাকেন। সবাই কেন এই নামে ডাকেন জানতে চাইলে তিনি জানান, করোনাকালে যখন জীবনযাত্রা অনেকটা স্থবির। মানুষের নির্ভরশীলতা তৈরি হয় অনলাইন কেনাকাটার প্রতি।
কিন্তু এই সফলতায় আসতে সুভামনিকে পারি দিতে হয়েছে দীর্ঘ এক পথ। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা হারা হন সুভামনি। মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পড়াশোনা চলতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়েনা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শারীরিক এক জটিলতা ধরা পড়ে। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। সেই থেকে এখন অব্দি সারা শরীরের মাসল পেইন নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেও সারেনি এই সমস্যা। একটানা অনেকক্ষণ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না তিনি। তারপরও দমে যাননি। এগিয়ে যান নিজের স্বপ্ন বোনার আকাঙ্ক্ষায়।
সুভামনি জানান, প্রথম থেকেই পরিবারের সহযোগিতা ছিল। কেউ ভাবতে পারেনি আমার এই কাজটি এতদূর নিয়ে আসতে পারব। তিনি জানান, ছোটবেলার স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে দেশ ও দশের সেবা করার ইচ্ছে থাকলেও সে স্বপ্নের অপমৃত্যু হলেও আমি দমে যাইনি। একটু একটু করে সামনে অগ্রসর হতে থাকি। অষ্টম শ্রেণির পর বরিশাল থেকে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় আসি। কিন্তু পরিবারের আগ্রহ থাকায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই ব্যবসায়ী পাত্রের সঙ্গে। ব্যবসায়ী স্বামীর কারণে উদ্যোক্তা হওয়ার পথটি আমার আরও সুগম হয়। স্বামীর সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও পরামর্শ আমাকে সামনে চলতে আরও উৎসাহ দেয়। এভাবেই মূলত আমি আজকের অবস্থানে।
প্রান্তিক পর্যায় থেকে প্রাকৃতিক নানা পণ্য সংগ্রহ করা হয় বলে নামকরণ করেন প্রকৃতির উপহার। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় ভোক্তাদের কাছে কুরিয়ার ও অন্যান্য মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তিনি। প্রকৃতির উপহারের সেবাসমূহের মধ্যে আছে- সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু, খাঁটি নারিকেল তেল, কাঠের ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল, খাঁটি গাওয়া ঘি, গরুর ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল, পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়, ভাঁড়ের গুড় ইত্যাদি। সঙ্গে সংযুক্ত হয় সময়োপযোগী ও মৌসুমি অন্যান্য পণ্যও।
বর্তমানে মাসে খাঁটি পণ্য ক্রয় করে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করার পুরোটা প্রক্রিয়ায় রাখছেন সামান্য লভ্যাংশ। খুব কম লাভে পণ্য বিক্রি করছেন দাবি করে সুভামনি জানান, মূলত এটি আমার একটি সমাজসেবামূলক কাজ। আমি চাই কম লাভে সঠিক পণ্যটা একবারে তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। আশা করি সুভামনি তার এই ব্যবসা আরো সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হবে। প্রকৃতির উপহার নিয়ে তিনি আরো সামনে এগিয়ে যাবেন।