Skip to content

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আপনার ছেলে সন্তানকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখান

একটি শিশুর কাছে তার শিক্ষার প্রথম ভিত্তি তার মা-বাব। আপনার সন্তান যা দেখবে, তাই শিখবে; যেভাবে দেখবে, সেভাবেই করতে শিখবে। পরিবারের ভেতরে যদি কখনো তার বাবাকে দেখে মাকে শারীরিক নির্যাতন করতে কিংবা অপমান করতে, সেই শিশু যত ভালো প্রতিষ্ঠানেই পড়ুক না কেন, তার গভীরের শিক্ষা তার আচরণে বেরিয়ে আসবেই। সে নারীকে সারাজীবন সেই নজরেই দেখবে, যেভাবে সে পরিবার থেকে শিখে এসেছে। এর খুব বেশি একটা ব্যতিক্রম হওয়াটা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। 

 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দিকে এগুচ্ছে দেশ। অর্থনীতি, নারীশিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন- সবদিক থেকেই উন্নত দেশের কাতারে যাবার অপেক্ষারত এখন বাংলাদেশ। অর্থাৎ গত ৪৯ বছরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় সূচকেই অনেকটা এগিয়ে গেছে দেশ। শুধু তাই নয়, লিঙ্গ সমতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। 

 

দেশের এতো এতো অর্জন আর সফলতার মধ্যেও একটা প্রশ্ন যেন থেকেই যায়। আমরা কি আসলেও নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছি? নাকি এতো সব অর্জন আর সাফল্যের মাঝে নারীর প্রতি সম্মান এবং তার নিরাপত্তার বিষয়কে একরকম ভুলতে বসেছি? পুরুষের সঙ্গে তুলনা করলে, আমরা কি নারীদের জন্য একইরকম নিশ্চিত ও সহিংসতা মুক্ত সমাজ পেয়েছি? সহজ উত্তর, না।

 

বিগত কয়েক মাস ধরে দেশের প্রায় সবগুলো সংবাদ মাধ্যমে সর্বাধিক প্রকাশিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ধর্ষণ। শুধু তাই নয়, করোনাকালে সারাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। এর একটি বড় জায়গা জুড়েই রয়েছে দাম্পত্য কলহের জের ধরে পারিবারিক নির্যাতন। গত বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বে ছিল এই নারী সহিংসতার হার। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ২৪৯টি। এই সময়ে ৪২৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪২টি শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। 

 

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এর তথ্য মতে, দেশে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এছাড়াও করোনার কারণে স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। আইনি তৎপরতাও ব্যর্থ হয়েছে বাল্যবিবাহ আটকাতে।  

 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণ ও গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৬২৭ নারী। যেখানে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪১৩ নারী এবং ২০১৮ সালে ছিল ৭৩২। দেশে নারী ধর্ষণের হার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এছাড়াও পারিবারিক নারী নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, সালিশের মাধ্যমে নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, হয়রানির ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

 

পরিসংখ্যান বাস্তবতার একটা চিত্র তুলে ধরে মাত্র। বাস্তবতা আরও নিষ্ঠুর। গত এক বছরেই বাংলাদেশ দেখেছে বেগমগঞ্জে নিজের মেয়ের সামনে মাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হলে, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, স্যোশাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অনন্ত জলিলের মতো মানুষও ধর্ষণের কারণ হিসেবে মেয়েদের পোশাকের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন, যেন মেয়েরা পোশাকের কারণে বা নিজের দোষেই ধর্ষিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর তো ধর্ষণের অভিযোগ তোলা নারীকে ‘দুশ্চরিত্র' বলছেন। সংবাদ মাধ্যমে এমন কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। ধর্ষণ থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি, সবখানেই সব দোষ যেন নারীরই। হয় তার পোশাকের, নয়তো চরিত্রের। এজন্যই লিঙ্গ সমতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান কিংবা নারীর নিরাপত্তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন ওঠে। হায়রে! মেয়েদের প্রতি সম্মান দেখাতে কি খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়? মোটেই না। পারিবারিক শিক্ষাই মানুষের জীবনের শিক্ষার মূল ভিত্তি গড়ে দেয়, যাকে আমরা জীবনের প্রথম স্কুলও বলে থাকি। আর সেই গোড়াতেই যদি গলদ থেকে যায় তাহলে আর কখনো মনে হয় শোধরানো হয়ে ওঠে না। 

 

একটি শিশুর কাছে তার শিক্ষার প্রথম ভিত্তি তার মা-বাব। আপনার সন্তান যা দেখবে, তাই শিখবে; যেভাবে দেখবে, সেভাবেই করতে শিখবে। পরিবারের ভেতরে যদি কখনো তার বাবাকে দেখে মাকে শারীরিক নির্যাতন করতে কিংবা অপমান করতে, সেই শিশু যত ভালো প্রতিষ্ঠানেই পড়ুক না কেন, তার গভীরের শিক্ষা তার আচরণে বেরিয়ে আসবেই। সে নারীকে সারাজীবন সেই নজরেই দেখবে, যেভাবে সে পরিবার থেকে শিখে এসেছে। এর খুব বেশি একটা ব্যতিক্রম হওয়াটা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। 

 

বাঙালি হিসেবে আমরা কে না জানি যে, পরিবারের ভেতর ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আলাদা চোখে দেখা হয়। পরিবারের ছেলেরা পায় অধিক আদর, কারণ সে ‘বংশের বাতি', তারা মা-বাবাকে রোজগার করে খাওয়াবে, দেখাশোনা করবে আর মেয়েরা তো চলে যাবে পরের বাড়ি! কাজেই খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া সব ব্যাপারেই সকলের মনোযোগ থাকে ছেলেদের প্রতি। আজকাল ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই সমানভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলেও, চিন্তার পরিবর্তন খুব বেশি একটা আসে নি বললেই চলে। পরিবারের ভেতর  ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অন্য কোন বিষয়ে বৈষম্য না থাকলেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিন্তু ঠিকই বৈষম্য করা হচ্ছে এখনো৷ ভাইদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকায় পাঠানো হয়েছে আর মেয়েদের বেলায় শুনেছি উচ্চশিক্ষিত পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে হবে৷

 

যা-ই হোক, ছেলেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে এরকম অনেক মা-বাবাকে বুড়ো বয়সে ছেলেদের বাড়িতে না থেকে মেয়েদের সংসারে থাকতে দেখা যায় আজকাল। কিন্তু এতে কি মানুষের মানসিকতায় তেমন পরিবর্তন এসেছে? আমার কিন্তু মনে হয় না। নানাভাবে নারীদের প্রতি পুরুষদের অসম্মান আর বৈষম্য দেখে মনে হয়, আমরা এখনো অ-নে-ক পিছিয়ে আছি।

 

একদিনে যেমন সমাজ কিংবা দেশের সব পরিবর্তন সম্ভব না, তেমনি একদিনে সমাজের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মানসিকতায় পরিবর্তনও সম্ভব না। পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে একেবারে গোঁড়ায়। পরিবার থেকেই এই শিক্ষার শুরুটা করতে হবে আমাদেরকেই। সন্তানকে শেখাতে হবে নারীকে সম্মান করতে। কেননা, মানসিকতার পরিবর্তনের প্রধান প্রতিষ্ঠান আসলে পরিবারই, যেখানে আপনি আপনার ছেলে সন্তানকে নারী ও মেয়েদের সম্মান করতে, বোনের সঙ্গে খাবার থেকে শুরু করে সম্পত্তি পর্যন্ত সবকিছুই সমানভাবে ভাগাভাগি করে নিতে শেখাতে পারেন।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ