যে ঋতু’র প্রতিস্থাপন নেই
ঙ্গনে ঋতুপর্ণ ঘোষ একটি সুপরিচিত নাম। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা চলচ্চিত্রকে পাশে নিয়ে নিরলস হেঁটেছেন তিনি অনেকটা পথ, ক্লান্তি-ক্লেশ অবদমন করে পৌঁছে দিয়েছেন অন্য এক মাত্রায়। পারিবারিক বা মানবজীবনের পারস্পারিক-মানবিক সম্পর্কগুলোর মধ্যকার জটিল মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনকে এতো সহজ করে তিনি সিনেমায় উপস্থাপন করেছেন, যেকোন শ্রেণীর দর্শক তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারে না।
বাঙালি পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, আলোচিত ও বিতর্কিত চলচ্চিত্র পরিচালকদের একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ। শিল্প দক্ষতা ছিল তাঁর নখদর্পণে। সেই শিল্পের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিজের পরিচালনা এবং অভিনয়ের জগতে। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর বাংলা চলচ্চিত্রে সে-সময় এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। চলচ্চিত্রের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা’ এবং ‘বাণিজ্যিক ধারা’র মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছিল। এই দুই ধারার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘উনিশে এপ্রিলে’র মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সিনেমা হলে ফিরিয়েছিলেন তিনি। তিনি নিজেও সত্যজিৎ রায়ের অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন।
১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় ঋতুপর্ণ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-মা উভয়েই চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও চিত্রকর। সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের পর তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেন। তার ব্যক্তিত্বের বিশেষত্ব হল তিনি সকলের সামনেই তার সমকামিতা হওয়া স্বীকার করেছেন, যা চলচ্চিত্র জগতে খুব একটা দেখা যায়না।
শিল্প জগতের কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়ের মতো ঋতুপর্ণ ক্যারিয়ার শুরু করে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে। ৮০ এর দশকে তিনিই প্রথম কলকাতার বিজ্ঞাপন জগতে বাংলা লাইনে বিজ্ঞাপন লেখা শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে “বরোলিন” এর বিখ্যাত এক লাইনের বাংলায় কপি লেখার পথিকৃৎ এই ঘোষবাবুই ছিলেন। কলকাতার বিজ্ঞাপন জগতের মতোই কলকাতার চলচিত্র জগতের পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে তিনি বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপরেই তার সিনেমা জগতে প্রবেশ।
১৯৯২ সালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তাঁর পরিচালনায় মুক্তি পায় প্রথম ছবি হীরের আংটি। ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ছবি ‘১৯ এপ্রিল’ মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তার মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। তাঁর এই ছবিটি শুধু বাণিজ্যিক ভাবেই সফল হয়নি, জিতে নিয়েছিল জাতীয় পুরস্কারও। এরপর থেকে একের পর এক সুন্দর সুন্দর ছবি নির্মাণ করতে থাকেন ঋতুপর্ণ। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় তার সিনেমা দহন। ১৯৯৮ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই ছবির দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রাণী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।
শুধু ১৯ এপ্রিলই নয়, তাঁর তৈরি রেনকোট, চোখের বালি, তিতলি, উৎসব, অসুখ, দ্যা লাস্ট লিয়র, সব চরিত্র কাল্পনিক, আবহমান, অসুখ, উৎসব, খেলা সহ বহু ছবি বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে তিনি তৈরি করেছিলেন চোখের বালি। এই ছবিতেই তিনি প্রথম বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বর্যা রাইকে নিয়ে কাজ করেন।
২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। ইংরেজি সিনেমা দ্যা লাস্ট ইয়ার সেরা চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। হেনরির ছোটোগল্প “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া সব চরিত্র কাল্পনিক শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০০৯ সালের ছবি আবহমান শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। ঋতুপর্ণের শেষ ছবি ‘সত্যান্বেষী’। গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটির শুটিং শেষ করে তিনি মারা যান। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি কিছু সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন।
ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। রবি ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’কে সমকামী প্রেম ও রূপান্তরকামী এক মানুষের ইচ্ছের ওপর দাঁড় করিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। কাহিনির বন্ধনে একটা যুক্তি-তক্কো-গপ্পের আসর, যা ক্রমাগত প্রসঙ্গ তুলে আনে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত জনপ্রিয়তম নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’-র। তিনি নিজেও অভিনয় করেছেন এই সিনেমায়। অনেকে চিত্রাঙ্গদাকে তার শ্রেষ্ঠ নির্মাণ হিসেবে গণ্য করে থাকেন। ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।
তবে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে নয়, একটি জনপ্রিয় ফিল্ম ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসাবেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। টেলিভিশন চ্যানেলে দুটি জনপ্রিয় চ্যাট শো পরিচালনা করেন তিনি। সবমিলিয়ে সিনেমা থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। দুই বাংলার জনপ্রিয় নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় “সঙ্গে সৃজিত” নামক অনুষ্ঠানে একবার বলেন- “ঋতু’ই আমাকে পয়েনজিত থেকে প্রসেনজিৎ তৈরি করেছে। সে আমার এই জগতের বাপ ছিলেন”।
অসাধারণ নির্মাণের জন্য তিনি পেয়েছেন ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তা ছাড়া বার্লিন, লোকার্নো, শিকাগো, বুসান, বোম্বে প্রভৃতি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন গুণী এই নির্মাতা। বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদান ভোলার মতো নয়। তার অমর সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। আজ তার মৃত্যু দিবসে অনন্যা পরিবারের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।