Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আইন অনুযায়ী কোনটি ধর্ষণ ও কোনটি ধর্ষণ নয়

বিবাহিত স্ত্রীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রেমিক-প্রেমিকা যদি বিয়ের আগেই পরস্পরের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেটা কি? সেই প্রেমিকা যদি হন অপ্রাপ্তবয়স্ক? বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ-ই বা কাকে বলা হচ্ছে?

বর্তমানে ধর্ষণ বাংলাদেশের একটি অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই ধর্ষণের প্রকৃত আইন সম্পর্কে অবগত নই। কখন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও কি সেটা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে সেই সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই। ধর্ষণের ভুল ব্যাখ্যার কারণে এই অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে গিয়েছে। আবার বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন বিরোধী কঠোর আইন থাকলেও এ নিয়ে বিভ্রান্তিও কম নেই।
চলুন জেনে নেয়া যাক ধর্ষণের পেছনের আইনি ব্যাখ্যা:

প্রথমত, ১৬ বছরের কম বয়েসি নারীর সম্মতি গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী হয়েছে ১৬ বা তার কম বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে শিশু হিসেবে ধরা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদার মতে, এই বয়সে মৌখিক বা লিখিত কোন সম্মতি দেয়ার মতো ক্ষমতা শিশুর গড়ে ওঠে না। তাই এই বয়সী কেউ যদি যৌন সম্পর্কে সম্মতি দিয়েও থাকে সেটা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে যদি কোন পুরুষ ১৬ বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি নিয়েও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেটাও ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী। আর সম্মতি ছাড়া হলে তো সেটা অবশ্যই ধর্ষণ। সেটা বয়স নির্বিশেষে ধর্ষণ।

আবার কোন অবিবাহিত নারী আদালতে যদি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, এমন অভিযোগও আনতে পারেন তাহলে সেটা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করবে বাংলাদেশের আদালত। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীর বয়স ষোলর বেশি হলেও আইনের দৃষ্টিতে ছাড় নেই। আবার ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাও ধর্ষণ।

আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে দায়ী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু শিশু আইনে শিশুর সংজ্ঞায় বয়সের সীমা রাখা হয়েছে ১৮ বছর বা তার কম। সেক্ষেত্রে অপরাধীর ক্ষেত্রে এই বয়স প্রাধান্য পাচ্ছে। ভুক্তভোগীর বয়স এখানে মুখ্য নয়। তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স যদি ১৮ বা তার কম থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হলেও সেটার বিচার হবে শিশু আইনে।
অন্যদিকে, নারী ও শিশু দমন নির্যাতন আইনে মামলা সত্ত্বেও ভুক্তভোগী যদি বেঁচে থাকেন এবং তার বয়স যদি ১৮ বছরের নীচে থাকে তাহলে তার শিশু আইনের আওতায় শিশু আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসার সুযোগ আছে।

দ্বিতীয়ত, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ। আইনে যেহেতু বলা আছে, যদি প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতি আদায় করে যৌন সম্পর্ক করা হয়, তাহলে সেটা ধর্ষণ হিসেবে দেখা হবে। কিন্তু বিয়ের প্রলোভন দেখানোর বিষয়টি প্রতারণামূলক ভাবে সম্মতি আদায়ের মধ্যে পড়লেও আদালতে অনেক সময় সেটা নাও টিকতে পারে। এটি মূলত নির্ভর করে কতদিন ধরে বিয়ের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সম্পর্কের গভীরতা কেমন ছিল, লিখিতভাবে বিবাহিত না থাকলেও ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে করেছিলেন কিনা, কোন সাক্ষী আছেন কিনা সেগুলোর ওপরেও নির্ভর করে বলে জানান তাকবির হুদা।  

তৃতীয়ত, বিয়ের পর ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ। বিয়ের পর স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাও ধর্ষণ এর মধ্যে পড়ে। এটিকে বলা হয় ম্যারিটাল রেপ। পৃথিবীর কোন কোন দেশে ম্যারিটাল রেপ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত এবং শাস্তিযোগ্য। জাতিসংঘও এটিকে ভয়াবহ ধরণের পারিবারিক সহিংসতা বলে মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এমন অপরাধের উল্লেখ নেই।
অর্থাৎ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, বিবাহিত স্ত্রীর সাথে তার অনিচ্ছায় বা জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও সেটা যৌন সহিংসতা বা যৌন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। তবে বিবাহিত স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছরের কম হয়, এবং তার স্বামী যদি জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করেন তাহলে ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে শাস্তি শুধুমাত্র অর্থদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবীর হুদা। আর স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছর বা তার বেশি হয় তাহলে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের ফৌজদারি মামলা দায়েরের কোন সুযোগ নেই।

গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে। এর ফলে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়া সপ্তম দেশ হল বাংলাদেশ।

যদি কোন ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে। এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হবে। এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোন নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

ধর্ষণ নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ভাব রয়েছে। প্রত্যেককে বুঝতে হবে ধর্ষণের জন্য নারীরা দায়ী নয়। প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে কোনটা ধর্ষণ ও কোনটা ধর্ষণ নয়। ধর্ষণ নিয়ে সচেতনতাই পারবে এই সামাজিক ব্যাধিটিকে রুখতে।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ