হারিয়ে যাওয়া বিয়ের সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মিলন
বাঙালির বিয়ে মানে সাহিত্য আর সংস্কৃতির ভুরি ভুরি আয়োজন। গান, কবিতা, ছড়া আর হরেক রকম গদ্য ছন্দ দিয়ে সাঁজানো থাকতো বিয়ের আসর। এছাড়াও থাকতো নানারকমের সাংস্কৃতিক আয়োজনও। ক্রমাগত হারিয়ে যেতে বসেছে এসব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিবাহের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক দিক নিয়েই এবারের আয়োজন।
ছড়া
এইতো কিছুদিন আগেও বিয়েতে চলতো গান, চলতো ছড়া আর কবিতা। আর বিয়ের পদ্য লেখার জন্য মানুষজন চলে যেতো যশস্বী কবি, কবিয়ালদের কাছে। তারাই খুব যতœ করে লিখে দিতো এসব ছড়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পদ্য না লিখলেও অনেক বিয়েতে তিনি আশীর্বাণী লিখে দিতেন। লীলাদেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা ইন্দিরা, লালাগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ এবং কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়েতেও তিনি সানন্দে আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন বলে জানা যায় বেশ কয়েকটি বইয়ে। তবে প্রথম শ্রেণির বিয়ের পদ্যকার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। কাটোয়ার ডাকসাইটে ডেপুটি ছিলেন কবি তারকচন্দ্র রায়। তারকবাবুর শালার বিয়েতে পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। আচার্য হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সংগৃহীত সেই পদ্যটি লেখা হয়েছিল ১৩২২ সালের ১৮ মাঘ। পদ্যটি লেখা হয়েছিল তারকবাবুর নাতির নামে,
‘আজকে তোমার বইবে তুফান বুকে
মুখেতে আর বলবো আমি কত
দুই জনেতে থাক পরম সুখে
একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মতো।’
বিয়ের পদ্য কবে থেকে শুরু হয়েছিল এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। যতীন্দ্রমোহন গুপ্তের মতে, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়ের সময় প্রথম পদ্য ছাপানো হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ শতকে পদ্য প্রথা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে লেখা হতো পদ্য। যেমন,
‘বন্ধু তোমায় জানাই খবর
হয়তো তুমি হাসবে।
৮ই ফাগুন আমার বিয়ে
নিশ্চয় তুমি আসবে।’
সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে বর-কনেকে গোসল করানোর সময় একপ্রকার বিশেষ নাচের প্রচলন দেখা যায়। এ নাচের সময় গাওয়া হয়,
‘একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনী
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনি।’
সিলেট এলাকায়ও বিয়ের এমন গানের প্রচলন রয়েছে। নিচে একটি গানের নমুনা উল্লেখ করা হলো,
‘দেখছি কইন্যার মাথা ভালা ডাব নারিকেল জুড়ারে
দেখছি কইন্যার দাঁত ভালা আনারের দানারে
দামান্দেরও সাত ভাই সাত ঘুড়া ছুয়ারী
একেলা দামান রাজা চৌদল চুয়ারী
চৌদলের কিনারে পড়ে হীরা লাল মতিরে
চল যাই চল যাই দামান দেখিবারে।’
মহাভারতীয় যুগের বিবাহ
মহাভারতীয় যুগে চার ধরনের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়, ব্রাহ্ম, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস। এর মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহেই মন্ত্র উচ্চারণ ও যজ্ঞ সম্পাদনের প্রয়োজন হতো। বাকী তিন ধরনের বিবাহে এসবের কোন বালাই নেই। আবার যাজ্ঞবল্ক্য ও মনুস্মৃতিতে আট ধরনের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই আটরকম বিবাহ হচ্ছে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ।
যদিও মহাভারতীয় যুগে আট ধরনের বিবাহের কথা বলা হয়েছে তবে উচ্চবর্ণের মধ্যে দু ধরনের বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিলো। এগুলো হলো ব্রাহ্ম ও গান্ধর্ব্য। গান্ধর্ব্য বিবাহ সম্পর্কে অতুল সুর তার বইতে বলছেন, ‘নির্জনে প্রেমালাপ করে যেখানে স্বেচ্ছায় মাল্যদান করা হতো তাকে বলা হতো গান্ধর্ব্য বিবাহ।… মহাভারতের নায়কদের মধ্যে অনেকেই গান্ধর্ব্য মতে বিবাহ করেছিলেন।’
হিন্দু বিয়ের সাত পাক
হিন্দু মতে বিয়েতে আগুনের কুন্ডলীর চারপাশে বর-বউকে ঘুরতে দেখা যায়। একে সাত পাকে বাঁধা পড়া বলা হয়। বলা হয়, এর মাধ্যমে অগ্নিদেবতাকে বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়। শুধু আগুনের চারপাশে ঘোরাই নয়, এই সময়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দিতে হয় একে অপরকে। এখানে সাত পাকে সাতটি প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন বর-কনে উভয়েই।
মুসলিম সমাজের বিবাহ
ভারত উপমহাদেশে মুসলিম বিয়ের অন্ষ্ঠুানে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠান ও উৎসব-আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা হয়। তবে এসব বিয়ে মুসলিম সংস্কৃতি মেনে করলেও নানা সংস্কৃতির সম্মিলনে এখানকার বিয়ে অনুষ্ঠান একেবারেই ষোলআনা মুসলিম থাকেনি। এখানে অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে এসেছে নতুন নতুন সংস্কৃতি। এখানে মূল বিবাহ অনুষ্ঠানের আগে প্রথমে ফর্দ করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ব্যক্তিরা সেখানে (হুজুর-মৌলভি) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং বিবাহের জন্য তার আশীর্বাদ, অনুগ্রহ ও সাহায্য চাওয়া হয়। বিবাহের মূল পর্ব অবশ্যই মৌলভি, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে সংঘটিত হয়।
মুসলমানরা মুসলিম ব্যতীত কিতাবিয়া নারীকে বিয়ে করতে পারলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এর প্রচলন একেবারেই নেই। এখানে বহুপত্নী গ্রহণের নিয়ম থাকলেও এ পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
বিবাহের উপর গণতান্ত্রিক প্রভাব
সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্য দেশের চিন্তাধারার প্রভাব পড়েছে বিবাহ জীবনে। দুই একদিনে এ পরিবর্তন আসেনি। দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফলে এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। এ পরিবর্তনের সূচনা হয় রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের পর বিধবা বিবাহের প্রচলন আরও একধাপ এগিয়ে যায়। ১৮৭২ সালের ৩ নং আইনের মাধ্যমে সবর্ণ বিবাহের বাধাও দূর হয়। এভাবেই ধাপে ধাপে বিবাহ আর স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের গণতান্ত্রিক প্রভাব নিশ্চিত হয়।