Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনায় বাড়ছে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মনি। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মনির বাড়ি উত্তরের জেলা নীলফামারীর ডোমারে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় চলা পরিবারটি করোনার কারণে থমকে আছে। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। মনির বাবা একজন ব্যবসায়ী। করোনায় তার ব্যবসা এখন ক্ষতির মুখে। এসময় প্রবাসী এক পাত্রের (আব্দুল্লাহ) সঙ্গে মনির বিয়ের কথা হয়। মনির বাবা পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মনির সঙ্গে আব্দুল্লার বিয়ে দেন। আব্দুল্লাহ মনির থেকে বয়সে ১৩ বছরের বড়। কোনোরকম অনুষ্ঠান ছাড়াই তারা মেয়ের বিয়ে দেয়। মনির বাবার ধারণা, বয়স বেশি হয়ে গেলে মেয়ের বিয়েতে অনেক টাকা পণ লাগতে পারে। আর এরকম পাত্র তারা খুঁজে নাও পেতে পারেন।

 

কোভিড-১৯ এর কারণে চলতি বছর মার্চ থেকে যেন অধিকাংশরই হাত বন্দী। দরিদ্র পরিবারের যেন তা আরও বেশি। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। ধাক্কা খেয়েছে দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থা। আর এই সময় মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহ। এ পরিস্থিতিতে কম বয়সে অনেক মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে৷ একরকম জোরপূর্বকই তাদেরকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।

 

করোনা পূর্ববর্তী সময়ের থেকে করোনা পরবর্তী সময়ে বাল্যবিবাহের পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।  মনি তার একটি উদাহরণ মাত্র। অল্প বয়সে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়েছে। 

 

শিশু অধিকার সুরক্ষা সংস্থা 'সেভ দ্য চিলড্রেন' এরই মধ্যে আশঙ্কা করছেন, শুধু এ বছরই ৫ লাখ মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পরা দারিদ্র্য পরিবারগুলো এই মুহূর্তে আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য মেয়ে সন্তানকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন।গত ২৫ বছরের মধ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা এ বছর সবচেয়ে বেশি। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহের শিকার হতে পারে আরও অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে৷ ২০২৫ সালে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে মোট ছয় কোটি দশ লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সেভ দ্য চিলন্ড্রেন সংস্থাটি।

 

বাল্যবিবাহের পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বাবা- মা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ভুগছেন। যার কারণে অল্প বয়সে তারা মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। এছাড়াও এই সময় ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে সময় পার করছেন। নিকটাত্মীয়দের থেকে অনেকসময় মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই ভয় থেকে অভিভাবকরা অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।

 

সম্প্রীতি দেশে ধর্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অল্প বয়সী মেয়েদের রাস্তা ঘাটে অনেক বেশি হেনস্তার শিকার হতে হয়। এছাড়াও এই সময় বেশির ভাগ মানুষ ঘর বন্দী। আশেপাশের বাড়িতে যাতায়াত কমে গেছে। সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ বিধায় কম খরচে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। পরিবারের লোকজন মিলে বিয়ে দিচ্ছে মেয়ের। অপর পাশে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এখন অনেকটা কম আর এই সুযোগটাকেও কাজে লাগাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। প্রশাসন খবর পেয়ে অনেক বিয়ে বন্ধ করলেও বেশিরভাগ বিয়েই হচ্ছে গোপনে।

 

করোনায় অনেক প্রবাসী ছেলে দেশে ফিরে এসেছে। আর আমাদের দেশে প্রবাসী ছেলের পাত্র হিসেবে কদর বেশি।  যার কারণে প্রবাসী ছেলে হাতছাড়া না করার লক্ষ্যে অনেক মেয়েকে ষোলো- সতেরো বছরে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাড়ছে বাল্যবিবাহের সংখ্যা।দেশের বিভিন্ন জেলায় এই সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।

 

সম্প্রতি কুড়িগ্রামে একটি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, ২০১৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ আগস্ট পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহ হয়েছে ২৬০২টি এবং বিয়ে বন্ধ হয়েছে ৯৬১ টি। এর মধ্যে ২০২০ জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ হয়েছে ৩৩৯ টি এবং বন্ধ হয় ৭১টি। 

 

এছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত তিন এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে জানা যায়, নীরবে বিয়ে লেগেই আছে। আর এসব মেয়ে সাধারণত স্কুলের শিক্ষার্থী। আগে এসব মেয়েদের সাধারণত কলেজে উঠার পর বিয়ে হতো আর এখন হচ্ছে স্কুলের মেয়েদের। বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের সমাজ ব্যবস্থারও পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের সমাজে একটা মেয়েকে অর্থনৈতিক বোঝা মনে করা হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোর ধারনা, বিয়ে হলে হয়ত তাদের মেয়েরা নিরাপত্তা পাবে। ক্ষুধা এবং বঞ্চনা থেকে রক্ষা পাবে। আমাদেরকে এসব ধ্যান- ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সচেতন হতে হবে বাল্যবিবাহ রোধে।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ