জীবনকে যাপন নয়, উদযাপন করেন এলিজা!
যুগে যুগে এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন মহীয়সীরা। যারা অজস্র প্রতিবন্ধকতা, বাঁধা পেরিয়ে সমাজের নানান স্তরে দ্বার উন্মোচন করে গেছেন নতুন প্রজন্মের জন্য। একসময় নারীরা ঘরের বাহির হয়ে শিক্ষায় এগিয়ে যাবে তা ভাবাই যেত না। তারপর একদিন বেগম রোকেয়ার হাত ধরে নারীরা শুধু শিক্ষিতই হন নি। বরং সে আলোর পথ ধরে অবদান রেখেছেন সমাজের আরো অন্য সব সম্ভাবনার পথে। নারী নেতৃত্বের ভার নিয়েছেন, নারী বিজ্ঞানের পথে হেঁটেছেন, নারী আকাশ পাড়িও দিয়েছেন দায়িত্ব নিয়ে। শুধু তাই নয় এই নারীই আবার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে তুলে ধরেছেন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবন ও যাপনের গল্প। এমনকি সে নারী আবার সম্ভাবনা দেখেন নতুন কোনো আলোর পথে।
এলিজা বিনতে এলাহী। এমনই এক নারী, এমনই একজন অনন্যা। যাকে বলা হয় বিশ্ব পরিব্রাজক। যিনি আবার একজন শিক্ষিকা। তার থেকেও বড়, তিনি একজন মা।
নিজের আনন্দ, আত্মা কিংবা প্রাণের তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি যিনি ভ্রমণ করেন, দেশ থেকে দেশে, গ্রাম বাংলার পথে পথে ঘুরে বেড়ান পর্যটন শিল্পকে সম্ভাবনাময় করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। এই পর্যন্ত ৪৯ টা দেশ ঘুরেছেন এই নারী। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে নিজের ভ্রমণ নিয়ে বের করেন দুটো বই, এলিজা'স ট্রাবেল ডায়েরি এবং এলিজা'স ট্রাবেল ডায়েরি- ২। বাংলাদেশের ৬৪ জেলাও একবার ভ্রমণ শেষ করে ২০১৯ সাল থেকে দ্বিতীয়বারের মত পুনরায় ভ্রমণ শুরু করেছেন। বিভিন্ন জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার উপর তিনি ভিডিও চিত্র, ফোটোগ্রাফি ও লেখালেখি করেছেন।
এলিজা জানান, পর্যটন এমন একটা শিল্প যেখানে গ্রামের একজন অসহায় অক্ষর জ্ঞানহীন নারীও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় এমন অভিজ্ঞতাই হয়েছে তার। গৃহিনী নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগাযোগ করার মত ভাষা রপ্ত করে ভ্রমণে গাইড হিসেবে নিজেদের যুক্ত করেছেন। আমাদের দেশেও এমনটা হতে পারে বলে মনে করেন এলিজা। আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় আমাদের অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য বহনকারী স্থাপনা, প্রত্নতত্ত্ব রয়েছে। যেগুলো কে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারলে, তরুণদের শুধু ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে একটা ট্যুর দিয়ে আসার থেকে এসব ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত স্থানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশে বা বিশ্বের যেকোনো দেশে পর্যটন অর্থনৈতিক খাতেও এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করবে।
সামাজিক বাঁধা পেরিয়ে এলিজা আজ একজন সফল পরিব্রাজক হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন। ভ্রমন যার আত্মায়, রক্তে, মন- মননে মিশে গেছে। তবে নারীদের জন্য কোনো পথই সহজ সরলরেখার মত নয়। নিজের দায়িত্ব নিতে গিয়ে, নিজের জীবনকে উদযাপন করতে গিয়ে হাজার কটূক্তি ছুটে আসে,হাজারটা বাঁধা, দায়বদ্ধতা সামনে দাঁড়ায়। তারপরও যারা সেসব জয় করে জীবনকে যাপন করার বদলে উদযাপন করতে সফল হন, তারাই হয়ে উঠেন এলিজা। এলিজা বলেন, "Someone has to break the boundary." তাই স্বপ্নের পথে হাঁটতে গেলে চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে।" এমনটাই বিশ্বাস করেন এই সাহসী নারী। শুধু তাই নয়, স্বপ্নের পথে জীবনকে উদযাপন করতে গিয়ে ছেড়ে দেন নিজের ১৩ বছরের শিক্ষকতার মত পেশা। নিজের উন্নত সম্মানের ক্যারিয়ার ছেড়ে দেওয়ার মত চ্যালেঞ্জও নিয়েছেন অপরাজিত এলিজা।
হাজারটা লোককথা যখন মনের জোরে আঘাত করতো, তখন "আমার জীবনটা আমার, এ জীবনের পুনর্জন্ম হবে না। তাই নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, জীবনকে যাপন না করে উদযাপন করতে হবে" এমন ভাবনা দিয়ে নিজের মনের জোর ধরে রেখেছেন।
একজন মা হিসেবেও এলিজা অসফল নন। নিজের সন্তানকেও তিনি গড়ে তুলেছেন স্বাবলম্বী করে। জানান, প্রতিটা ভ্রমণ শেষে সন্তানকে নিজে থেকে ভ্রমণ সম্পর্কে গল্প শোনাতাম। একটা সময় পর তিনি ভ্রমণে গেলে ছেলে অপেক্ষা করতে শুরু করে গল্প শোনার জন্য। একদিন ছেলে নিজে এসেই বলে, তার বন্ধুদের মধ্যে এই দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি সম্পর্কে সবাই যতটুকু জানে, সে তার থেকে অনেক বেশি জানে। " আর একজন মা হিসেবে সে মুহূর্তটা আনন্দে অশ্রুসিক্ত হওয়ার মত ছিলো। মা হিসেবে তিনি তার ছেলেকে এই বিশ্বের সব হেরিটেজের জীবন্ত গল্প গুলো উপহার দিয়ে যেতে পারবেন।
এলিজা বলেন, আমি চাই মানুষ পর্যটনে পথে আসুক। এ পথে সমৃদ্ধি আছে। একটা গ্রামে যখন কয়েকশ বছরের পুরনো একটা স্থাপনাকে সংরক্ষণ করা যায়, আর সেটিকে যখন মানুষের কাছে তুলে ধরে হবে মানুষ তখন সেটা দেখতে আসবে। পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে সেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ হবে। আর এভাবে সেখানে অর্থনীতির চাকা সচল হবে। এমন ভাবনা থেকে এলিজা নিজের ভ্রমণে গল্প গুলো তুলে ধরেন মানুষের কাছে। এমন সম্ভাবনাময় পথের আলোর তরুণদেরকে দেখাতে চান এলিজা।
এলিজার মত কালজয়ী, জীবনকে উদযাপন করতে শেখানো মানুষ এ পৃথিবীতে বারবার আসবেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবনকে উদযাপন করার অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন।