শীতের সাথে বাড়ছে শঙ্কা
সারা বিশ্বকে এক নিমিষে থমকে দিয়েছে একটি ভাইরাস। প্রায় এক বছর হতে চললেও এখনো এই কোভিড-১৯ নামক এই ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিনের সন্ধান পায়নি কেউ। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশে চলে এসেছে শীত। আর সেই সঙ্গে দেশগুলো কাঁপছে এর দ্বিতীয় সংক্রমণের ভয়ে। ইতোমধ্যে লকডাউনও করতে বাধ্য হয়েছে কয়েকটি।
প্রায় এক বছর অতিবাহিত হলেও বিশ্বব্যাপী এখনো একের পর এক রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার লেখায় মত্ত করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশে সম্প্রতি এই ভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমলেও করোনার ভয়কে আরেক ধাপ বাড়িয়ে তুলছে শীতের আগমনী বার্তা। দেশে শীতের আগমন ঘটতে চলেছে। বাংলাদেশের শীতের সময় করোনার প্রভাব আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যেই বলেছে, আসছে শীতে করোনা ভাইরাস আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
আগে অনেকেই মনে করেছিলেন, ষড়ঋতুর এই দেশে যেহেতু গ্রীষ্মের দাপটটাই বেশি, তাই তীব্র গরম পড়লে করোনার সংক্রমণ হয়তো কিছুটা কমবে। চড়া তাপমাত্রায় করোনাভাইরাসের কার্যকরী ক্ষমতা কমে যাবে বলে আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু বাস্তবে এমনটা দেখা যায়নি। জুন জুলাই মাসের গরমেও দিব্যি জাঁকিয়ে ছিল করোনাভাইরাস। শীতকালে এই সংক্রমণ আরও তীব্র হবে, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে যাঁদের নিশ্বাসের কষ্ট আছে, শীতে তাঁদের সেই সমস্যা আরও বেড়ে যায়। আর করোনাভাইরাসও আমাদের শ্বাসনালীতে আক্রমণ করে। তাই শীতকালে এদের বিশেষ সাবধান থাকা জরুরি।
সাধারণত শীতকাল এলেই বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই সর্দি কাশি বা ফ্লু’র মত রোগ বেশি হয়। তবে সমস্যা হলো, শীতকালীন অন্যান্য ফ্লু’র লক্ষণ অনেকটাই মিলে যায় করোনার সঙ্গে। তাই শীতের সময়টাতে অনেক সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে। নিরাপদ এবং যথেষ্ট কার্যকরী করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসতে আসতে ২০২১-এর মার্চ মাস হয়ে যাবে বলে এখনও পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে। তার মানে গোটা শীতকালটা করোনা ভ্যাকসিন ছাড়াই আমাদের কাটাতে হবে। সর্দি-কাশির ধাত যাঁদের, তাঁদের একসঙ্গে করোনা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং সেটা হলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হতে পারে। সে কারণেই করোনা মোকাবিলার যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আসন্ন শীতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। করোনা মহামারী আবার দেখা দিলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থ খরচ করার বিষয়ে সর্বোচ্চ মিতব্যয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপের অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। এটা থেকে আমাদের নিরাপদে থাকতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শীতে তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতা করোনাভাইরাসকে আরও বেশি সময়ের জন্য বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেবে। সেই সঙ্গে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে করোনাভাইরাসটি মানুষের ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলবে। শীতকালে নিউমোনিয়া, হাঁপানি ও অন্যান্য সর্দি জনিত রোগের কারণে করোনায় মৃত্যুর হারও বাড়তে পারে।’
যুক্তরাজ্য, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার দাবি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়ে শীতকালে এ ভাইরাসটির প্রভাব আরও বাড়তে পারে। যুক্তরাজ্যের মেডিকেল সায়েন্সেস একাডেমির এক সমীক্ষায় সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে শীতকালে নতুন করে সংক্রমণের কারণে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলেছে, আর্দ্রতার এক শতাংশ কমলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ৬ শতাংশ হারে বাড়িয়ে দিতে পারে।
তারা আরও বলছে, কেবলমাত্র আর্দ্রতা কমে যাওয়াই কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে তাপমাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। ভারতের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি-ভুবনেশ্বর এবং এআইআইএমসের গবেষকদের একটি দল সম্প্রতি ওই দেশের নীতিনির্ধারকদের দেশটিতে বর্ষা ও শীতের সময় কোভিড-১৯ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। মৌসুমি বৃষ্টিপাত, ঠাণ্ডা বায়ুমণ্ডল এবং শীতকাল ঘনিয়ে আসাসহ পরিবেশগত ভাবেই ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
ভারতের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) এক সমীক্ষা অনুসারে, দেশটিতে আগামী শীতকালের শেষে প্রতিদিন প্রায় ২ দশমিক ৮৭ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। দেশটির বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব রাজস্থানের গবেষকরাও তাদের গবেষণায় শীত মৌসুমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পরিমাণ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় হাঁচি, কাশি থেকে ছড়ানো জীবাণুর ক্ষুদ্র কণাগুলো বাতাসে অনেকক্ষণ ধরে ভেসে থাকে। গরমে এটা দ্রুত ধ্বংস হলেও শীতে ধ্বংস হতে সময় নেয়। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ভাইরাসকে অতি দ্রুত ধ্বংস করতে সাহায্য করে। কিন্তু শীতের সময় অতিবেগুনী রশ্মির পরিমাণ কম থাকে। ঋতু পরিবর্তনের ফলে এ সময় শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই নানারকম রোগে আক্রান্ত হন। এ সময়ে অসুস্থ হওয়ার মূল কারণ হলো, বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগজীবাণু খুব সহজেই ছড়িয়ে পরে। তাই এসব ভাইরাস থেকে বাঁচতে বেশি বেশি গরম পানি পান করতে হবে। সকল বয়সের মানুষকে ফলমূল, শাকসবজি ও সুষম খাদ্য খেতে হবে। যাতে করে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। পূরণ করতে হবে ভিটামিনের চাহিদা। শীতের সময় যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা খাবার যেমন আইসক্রিম, ঠাণ্ডা পানীয় ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. তাহমিনা শিরিন বলেন, নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিতে হবে। হাত-ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় শিষ্টাচার রক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো এতদিন ধরে বলা হচ্ছে সেটাই আরও কড়াকড়ি ভাবে পালন করতে হবে। করোনা সংক্রমণ কমাতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউনের মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনকে আরও কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
বর্তমানে সংক্রমণের হার কিছুটা কম হলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। তাই এই শীতে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির সদস্যরাও। করোনার টিকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে এই ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বারবার হাত ধোয়া বা পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলা হচ্ছে বার বার৷ শরীর ও জামাকাপড় নিয়মিত পরিষ্কার করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ কিন্তু তাপমাত্রা কমলে বারবার স্নান করা বা ঘন ঘন কাপড় ধোয়ার প্রবণতা কমবে৷ ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে৷ এছাড়া শীতে রোদ কম থাকলে শরীরে ভিটামিন ‘ডি'-এর যোগান কমে যায়৷ফলে কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা৷