Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়া

 

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা অর্জন করেছি এই স্বাধীন দেশ। বাস করছি এই স্বাধীন দেশে। এই স্বাধীন দেশের পিছনে রয়েছে অনেক সাহসী মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। তাদের সাহস, ত্যাগ আমাদের এনে দিয়েছে এই স্বাধীনতা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে দেশের জন্য লড়েছেন দেশের জন্য। অনেক নারী সাহসের সাথে মুখোমুখি হয়েছেন শত্রুদের। কখনো সামনে থেকে আবার কখনো আড়ালে থেকে। সেই সকল যোদ্ধাদের আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। অনেক সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধার নামই আমরা জানিনা, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া। আজ আমরা এক সাহসী নারীর কথা জানবো যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের হয়ে লড়েছেন। তিনি হলেন মুক্তিযোদ্ধা স্বর্ণলতা ফলিয়া।

 

১৯৫৪ সালের ৬ অক্টোবর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার সোনাইলবারী গ্রামে স্বর্ণলতার জন্ম। তাঁর বাবার নাম নিশিকান্ত ফলিয়া ও মা মারিয়া ফলিয়া। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোটালিপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়ী মিশনারি স্কুলের নবম শ্রেণীতে  পড়তেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। একদিন মাঠে খেলার সময় নারী মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্য তাঁকে এসে বললেন, “দেশে যুদ্ধ শুরু হচ্ছে, আমিতো যুদ্ধ করবো। তরা কে কে আমার সাথে যুদ্ধে যাবি।” 

এ কথা শুনে স্বর্ণলতা আর চুপ থাকতে পারলেননা। এক কথায়ই রাজি হয়ে গেলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। স্বর্ণলতা ৮ নম্বর সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাবসেক্টর কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নেয়ার আগে আশালতা বৈদ্যের সাথে যুদ্ধের সহপাঠী বন্ধুরা মিলে এলাকায় ঘুরতেন আর মহিলা মুক্তিযোদ্ধা জোগাড় করতেন। আশালতা বৈদ্য ৩৫০ জন নারীকে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড তৈরী করেছিলেন এবং ঐ কমান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

 

স্বর্ণলতারা সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে ঘরের মা-বোনদের নিয়ে “অস্ত্র ধরো, স্বাধীন বাংলা রক্ষা করো” স্লোগান দিতেন। এরপর জুন মাসে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলে ৩০ জন সদস্য নিয়ে তিনি হেমায়েত বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জানা যায়, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি গ্রামের হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। স্বর্ণলতার মা বাড়িতে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার দিয়ে সাহায্য করতেন।

 

সশস্ত্র যুদ্ধে তিনি বেশ কয়েকটি বিপদজনক অপারেশ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। একবার পাকবাহিনীর পাঁচটি লঞ্চ কাইজুর নদীর তীরে ছিল। স্বর্ণলতাসহ ১২-১৩ জনের একটি দল গিয়ে পানিতে ডুবে ডুবে লঞ্চগুলোর তলা ছিদ্র করে দিয়েছিলেন। ফলে পাকবাহিনীসহ লঞ্চগুলো ডুবে যায়। 

 

আরেকটি অপারেশন করেছিলেন নদীতে। এই অপারেশনে তাঁর পাশে থাকা দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বীরবিক্রম হেমায়েতউদ্দিনের গালে গুলি লাগে। অল্পের জন্য সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছিলেন স্বর্ণলতা। তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙে গিয়েছিলো।

 

এরপর দেশ স্বাধীন হলে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম শুরু করেন স্বর্ণলতা। স্বাধীনতার পরে আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে ঢাকা মেডিকেলে এসে কাজের সন্ধান করতে থাকেন তিনি। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও অসুস্থ বীরাঙ্গনাদের সহযোগিতা করার জন্যে মেডিকেলে কোনোরকমে তাঁর খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। 

 

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে স্বর্ণলতা তখন রাস্তা ও অন্যান্য জায়গা থেকে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে আসতেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে। বিভিন্ন অফিস- আদালত ও মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করে বীরাঙ্গনাদের চাকরির চেষ্টা করেছেন তিনি। তাদের চিকিৎসাসহ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি।

 

দুঃখের বিষয় হলো যে, আমরা অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। অনেক সাহস নিয়ে তিনি শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের এই সাহসকে আমরা সম্মান জানাই। আমরা চাই তাঁরা যেন তাঁদের সর্বোচ্চ সম্মান ও স্বীকৃতিটুকু পায়।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ