Skip to content

৬ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অভিনেতা থেকে হয়ে ওঠা একজন কবিনেতা

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বোধের সংমিশ্রণের সঙ্গে অভিনয়ের যে সম্পর্ক, অকৃত্রিম সম্পর্ক সে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে। মেধা আর মননশীলতা অভিনয়কে কতখানি বাস্তবতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিতে পারে, সব ধরনের অভিনয়ের ভেতর দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তা দেখিয়ে গিয়েছেন।

 

অভিনয় জগতে বোধের সংমিশ্রণের সাথে মিলনের উদাহরণ অনেক। এর একটি হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই। গল্প প্রচলিত আছে যে, হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ তে বাকের ভাইর ফাঁসির প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। এখানেই অভিনয়ের সাথে বোধের সম্পর্ক, সংমিশ্রণ। অভিনেতার অভিনয় দেখে দর্শক মনে করেছিল বাস্তবিক পৃথীবিতে ‘বাকের ভাই’ এর উপর অন্যায় করা হচ্ছে।

 

অভিনেতা থেকে হয়ে ওঠা একজন কবিনেতা

 

‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে দিয়েই সৌমিত্রের এ গুণ  আমরা দেখতে পাই। সেখান থেকে তিনি সুদীর্ঘ ষাট দশকের চলচ্চিত্রজীবনে তিনশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন প্রমুখ অভিনেত্রীর প্রথম কাজও তার বিপরীতে ছিল।

 

শুধু অভিনয়ে নয়, কবিতা আবৃত্তিতেও ছিল তার বেশ দখল। অভিনয় খ্যাতি এনে দিলেও সৌমিত্র কবিতা আর আবৃত্তি ছাড়েননি কখনো। সমানতালে চলেছে লেখালেখি, মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা। নিজের লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘টিকটিক, ‘নামজীবন’, ‘রাজকুমার’, ‘নীলকণ্ঠ’। অভিনেতা থেকে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন একজন কবিনেতা।

 

তার লেখা বইয়ের মধ্যে কয়েকটি হলো ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘মধ্যরাতের সংকেত’, ‘হায় চিরজল’, ‘জন্ম যায় জন্ম যাবে’, ‘যা বাকি রইল’, ‘হে সায়ংকাল’। কিন্তু তাঁর আবৃত্তির জগতে অধিকাংশ সময় ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। আর তাঁর দরাজ গলায় এসব কবিতাও পেয়েছে ভিন্নমাত্রা।

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কন্ঠস্বর ও দরাজ গলা নিয়ে প্রশংসায় মেতেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র ছেলে ও চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়। আনন্দবাজারে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব কিছু প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিল, ওকে কোনো চেষ্টাই করতে হয়নি, তা কিন্তু একেবারেই নয়। ‘অপুর সংসার’-এর সময় বাবা বলতেন, ওর গলার আওয়াজ বড্ড পাতলা। ও মা! সেই সৌমিত্রকাকু একজন দক্ষ আবৃত্তিকার হয়ে উঠলেন!’

 

সৌমিত্রের সংলাপের প্রশংসা করতে গিয়ে অভিনেত্রী ববিতা বলেছিলেন, ‘ক্যামেরার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সহশিল্পীর জন্য সংলাপ দিয়ে যাচ্ছেন। তাতে সংলাপটা কী যে স্বাভাবিক ও সুন্দর হয়ে উঠত। অন্যের অভিনয়ের জন্য, কেবলই শিল্পের জন্য এই দরদ কজনের হয়!’

 

অভিনেতা থেকে হয়ে ওঠা একজন কবিনেতা

 

সৌমিত্রকে পরমব্রত দেখতেন ফিদেল কাস্ত্রোর মতো করে। এটি জানা যায়, আনন্দবাজারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রকাশিত এক নিবন্ধে। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ওই প্রবন্ধে লিখেন ‘আমি কিউবা ঘুরেছি। যদিও সে দেশে কেউ খুব একটা ঘোরার জন্য যায় না। তো জেঠুকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) যখন বললাম, কিউবা ঘুরে এসেছি, উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখলি ওখানে?’ আমার সবটা দেখা জেঠুকে শুনিয়েছিলাম। শেষে বলেছিলাম, ‘জানো জেঠু, আমার মনে হয়, উত্তমকুমার বাংলা সিনেমার চে গেভারা, আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেন ফিদেল কাস্ত্রো।’

 

‘জেঠু বললেন, ‘কেন? এমনটা কেন মনে হয় তোর?’ আমি বললাম, দেখো, উত্তমকুমার যখন তার খ্যাতি ও সাফল্যের চূড়ায়, তখন মারা গিয়েছিলেন। ফলে তার সেই নায়ক ইমেজটা থেকে গিয়েছে। তাকে আর অন্য কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই দশা, সিরিয়াল- দেখতে হয়নি কোনো কিছুই। ঠিক যেমন রাজনীতিতে চে।’

 

অভিনেতা থেকে হয়ে ওঠা একজন কবিনেতা

 

‘আর ফিদেল? তাকে কত কিছু দেখতে হয়েছে। রাজনীতির পঙ্কিল অধ্যায় তো তাকেই কাটাতে হয়েছে। ঠিক তোমার মত। আসলে দীর্ঘ জীবন তোমায় আর ফিদেলকে এটা দেখিয়ে দিয়েছে। তাই উত্তম কুমার আমার কাছে বাংলা সিনেমার চে, আর তুমি ফিদেল।’

 

খ্যাতি হিসেবে চলচ্চিত্রে জগতে পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। এছাড়াও বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র। ফ্রান্স সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘লিজিয়ন অব দ্য অনার’পদক। ২০০৪ সালে ভারত সরকার তাকে দিয়েছে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব।

 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মিশুক এবং কৃত্রিমতা হীন। তাঁর মিশুক প্রকৃতির কথা বর্ণনা করেন সত্যজিত রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেত্রী ফরিদা আক্তার ববিতার সাথে পরিচয় যুবক সৌমিত্রের। সৌমিত্র সম্পর্কে ববিতা বলেন, ‘প্রথম দেখায় সৌমিত্রদা তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার বয়স তখন খুবই কম। সিনেমার পর্দায় যাঁকে দেখে অভিভূত হচ্ছি, সেই তিনি এমন করে তাকাচ্ছেন। বেশ ভয়ই লেগেছিল। এত বড় মাপের অভিনেতা, মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই অহংকারী হবেন। কিন্তু এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন, যেন খুবই আপন কেউ। ভয় মুহূর্তে উবে গেল।’

 

এমন প্রবীণ বটবৃক্ষ ঝরে গেলো রবিবার। এ কিংবদন্তি অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার চির অমর থাকবে বাঙালির মননে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ