ঋণমুক্তি
সেদিনের খবরের কাগজের ওপরে চোখ বুলিয়ে আমি প্লেটফর্মের এক প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলাম।লোকসভায় তৃ্তীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে তর্ক আলোচনা হয়েছে।বিরোধী সদস্যদের সমালোচনা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে প্রথম এবং দ্বিতীয় পরিকল্পনার দশ বছরের ভেতরে সর্বসাধারণ মানুষের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে,আর দেশের সমস্ত জনগণ ভালোভাবে খেতে পড়তে আর থাকতে পেয়েছে।
নেহেরুর কথা,আমি সবসময় বিশ্বাস করি। আর মানুষের অবস্থা সম্পর্কে বলা কথাটুকুর সত্যতা আমি নিজের ক্ষেত্রে উপলদ্ধি করছি।বারো বছর আগে পুলিশ বিভগে এ.এস.আই হিসাবে ভর্তি হয়েছিলাম। বর্তমানে আমি এস.আই যদিও একটা থানার চার্জে আছি,আর এই বছর না হলেও আগামী বছরে ইনস্পেকটর হওয়াটা এক প্রকার নিশ্চিত।ভালোভাবে কাজ করলে পুলিশ বিভাগে প্রমোশন বন্ধ রাখতে পারে না।
চাকরিতে ঢোকার আগে বড় দুঃখে দিন কাটাতে হচ্ছিল,গ্রামের ছেলে,পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিলাম না।পুলিশের চাকরিতে ঢোকা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।
হয়তো আমার সৌভাগ্যের জন্য সব সময় ভালো জায়গায় আমার পোস্টিং হয়েছিল। নিম্ন অসমের কয়েকটি জেলায় মৈ্মনসিঙের মানুষ বসবাস করা জায়গায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। পুলিশ অফিসারের জন্য অসমে মৈ্মনসিঙের লোকজন বসবাস করা জায়গা থেকে সুবিধাজনক জায়গা আর কোথাও নেই।এক একটি মামলায় কম করেও পাঁচশো টাকা হাতে আসে। ফরিয়াদি এবং আসামী দুপক্ষ থেকেই টাকা আসে।সাধারণ একটি মামলার তদন্ত করতে গেলে ন্যূনতম পঞ্চাশ টাকা পকেটে ঢুকে। তাছাড়া ওদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি ,মারামারি,মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকে।
সস্তায় পেয়ে এগারো হাজার টাকা দিয়ে এক টুকরো মাটি কিনে রেখেছিলাম।বর্তমানে সেখানে একটি বাড়ি তৈ্রি করেছি।ইতিমধ্যে বাইশ হাজার খরচ হয়ে গেছে,আর ও বারো-তেরো হাজার খরচ করলে বাড়ির কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে মনে হয়। টাকার জন্য অসুবিধা নেই। জিনিস পত্র পাওয়া নিয়েই সমস্যা। বড় ঘোরাঘুরি করতে হয়। কিছু জিনিস অবশ্য একটু বেশি দামে কিনতে হয়েছে,কাজ তো আর ফেলে রাখা যায় না।
তাছাড়া এই থানায় আরও কতদিন থাকতে হবে বলতে পারি না। এই থানার অন্তর্গত একটি গ্রামে আমাদের বাড়ি। ওপরওয়ালাকে কাকূতি মিনতি করে নতুন বাড়িটা মনের মতো করে সাজিয়ে নেবার জন্য এখানে বদলি হয়ে এসেছি। বেশিদিন এখানে রাখবে বলে ভরসা করতে পারছি না।
আমার থানা থেকে ছয়টা রেলস্টেশন অতিক্রম করলেই আমার নতুন করে তৈরি করা বাড়িটাতে যাওয়া যায়। থানায় অবশ্য জিপ,পিক-আপ ভ্যান এবং মোটর সাইকেল আছে,কিন্তু নিজের কাজে সেসবের ব্যবহার করতে ভালো লাগে না,রেল আছে। স্টেশন থেকে এক ফার্লং দূরে আমার নতুন বাড়ি। বাড়ির কাজের দেখাশোনা করে সন্ধ্যেবেলা থানায় ফিরে আসার জন্য প্লেটফর্মে দাঁড়িয়ে রেলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে । দেড় ঘণ্টার পথ,ওপাশেও স্টেশনের পাশেই থানা।
প্রথমে আমি খেয়াল করিনি। একবার এমনিতে চোখ পড়ল। একটি আধবয়সী ক্ষীণ চেহারার লোক আমার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বার কয়েক আমার সামনে দিয়ে ঘোরা-ফেরা করছে। কোনো গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন ছিল না। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ দেখলে অনেকেরই কৌতূহল হয়। তাছাড়া লোকটির কোথাও কোনো খুঁতও থাকতে পারে। না থাকলেও থাকাটা অসম্ভব বলে আমরা মনে করি না। আমাদের কাছে প্রতিটি মানুষই এক একটি পটেনসিয়াল ক্রিমিন্যাল।
আমি গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটি পুনরায় একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। দেখব না বলেও আমি মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম। মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি।বেশিরভাগই পেকে গেছে। গালের হাড় বেরিয়ে গেছে,একটু ছোট চোখদুটি গর্তে ঢুকে আছে। মুখটা বড় শুকনো এবং নিস্তেজ। মাথায় চুল প্রায় নেই। টাক মাথা। লোকটির গাল এবং কপালে কিছু রেখা। পরনে বহুদিনের পুরোনো একটি কামিজ। কামিজটা তাঁর পক্ষে ছোট। কলার,পকেট এবং হাতের আস্তিন যথেষ্ট ফাটা। শার্টটাও মলিন,বোতাম নেই। পুরো শরীরটা উদোম হয়ে পড়েছে। গেঞ্জি পরে নি। মানুষটার পায়েও জুতো নেই।
মানুষকে সূক্ষ্ণভাবে নিরীক্ষণ করাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই সাধারণভাবে চোখ বুলিয়েও আমি তার বিষয়ে একটা যথাযথ ধারনা করে নিলাম। অসমিয়া মানুষ,সে রেলস্টেশনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে সুযোগ পেলেই চুরি করে।। নতুবা পকেট কাটে। একবার আমার হাতে পড়লে বাছাধনকে আর দেখতে হবে না।
কিছুক্ষণ পরে ট্রেন চলে এল। আমি একটা দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় উঠে বসলাম। ছোট কামরা,কামরায় আর কেউ ছিল না। দুজন যাত্রী নেমে গেল,আর কেউ হয়তো এখানে উঠবে না। ভালোই হল। আমি আবার খবরের কাগজটাকেই আমার চোখের সামনে মেলে ধরলাম। ট্রেন ছাড়ার উপক্রম করতেই সেই লোকটি এসে আমার কামরায় উঠে পড়ল। আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় কাগজের দিকে নজর দিলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। রিভলভারটা আছে,আর এর মতো একটা মানুষের জন্য রিভলভারের কোনো দরকারই হয়তো হবে না।
মানুষটা বসেনি,ইতস্তত করছে।এবার আমি তার মুখের দিকে কঠিনভাবে তাকালাম। কিছুটা ইতস্ততঃকরে মানুষটা কিছুটা এগিয়ে এল দ্বিধান্বিত স্বরে ,কণ্ঠস্বরে যেন আনন্দ মিশেছিল,আমার দিকে তাকিয়ে বলল’তু—তুমি—আমাদের রামেশ্বরন?’
তার মুখে আমার নামটা শুনে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। রামেশ্বর ওসির নাম অনেকেই জানে। আর এর মতো মানুষেরা তো জানবেই।
আমি তাঁর মুখের দিকে সাধারণ কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকালাম। সে হয়তো সাহস পেল।
‘আমাকে চিনতে পারনি,কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম। আমি জয়রাম। মনে নেই বোধ হয়।’ আমি মানুষটার মুখের দিকে এবার তীব্রভাবে তাকালাম। হঠাৎ তাকে চিনতে পেরে গেলাম। স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। মানুষটা যে জয়রাম শর্মা আর তাকে যে এভাবে এখানে পেয়ে যাব তা আমি আশাই করতে পারিনি। বস বস,তুমি যদি আমাকে চিনতে পেরেছিলে,আমাকে পরিচয় দিলে না কেন?’
আমিও তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি আগের চেয়ে অনেক শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছ। আগের চেহারাও অনেক বদলে গেছে। বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছ। একালের সহপাঠী জয়রাম মিথ্যা কথা বলছে না। আমি প্রসঙ্গ বদলালাম এবং তার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম।
সিগারেট টানতে টানতে জয়রাম বলল ‘আমি কিন্তু তামাক খাই। গ্রামে এইসব দামি সিগারেট কোথায় পাবে। কিন্তু এখানে কোথায় এসেছিলে?’
‘অল্প মাটি কিনে রেখেছিলাম,সেখানে একটা বাড়ি তৈরি করেছি। মাঝে মধ্যে নিজে এসে দেখাশোনা না করলে আজকালকার ব্যাপার স্যাপার তো জানই।’‘
জয়রাম জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল,সে কিছু একটা চিন্তা করছে।
‘তুমি কোনদিকে এসেছিলে?’
‘আমি এদিকেই এসেছিলাম। বড়ছেলে এদিকেই থাকে। তার খবর নিতেই এসেছিলাম। সে একটু অসুস্থ। তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন?’
‘তিনটি। বড় দুটি ছেলে। দুজনেই শিলঙ থাকে।’
‘শিলঙ?’
কথাটা জয়রাম বুঝতে পারেনি। আমি বুঝিয়ে বললাম,আমাদের তো জানই কখন কোথায় বদলি করে দেয় তার কোনো ঠিক নেই। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেড়ালে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার কী হবে? ওদের শিলঙ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছি। হয়তো তখন ও জয়রাম বুঝতে পারেনি। সে পুনরায় বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘আচ্ছা এবার তোমার কয়জন ছেলেমেয়ে বল?’
‘আমার?কয়েকটা।বড় দুই মেয়ে।একজনের বিয়ে দিয়েছি।চার ছেলে।’
আরও অন্যান্য বিষয় নিয়েও আমরা কথা বললাম।মাঝখানে একবার জয়রাম বলল,তোমাকে উঠতে দেখেই আমি এখানে উঠেছি।আমার টিকেট কাটা হয়নি। কোনো বিপদ হবে না তো?’
আমি হাসলাম।‘কিছু হবে না।বসে থাক।আমি তো রয়েছি।আমিও টিকেট কাটিনি।’
‘তোমরা হলে অফিসার মানুষ,টিকেট না হলেও চলে যায়। অন্যান্য কথা বললাম।জয়রাম দেশের কথা জিজ্ঞেস করল,আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় আসবে কিনা,নাগা রাজ্য কীভাবে চলছে,নেহেরু এই বয়সেও এত কাজ কীভাবে করছে,ধান চালের আর অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম কখন ও সস্তা হবে কিনা ইত্যাদি নানা ধরনের কথা।
জয়রাম আগের মতোই রয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করার দরকার হল না সে আজকাল কী করে আর কীভাবে চলে। হয়তো তার বাড়ির অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নয়।
‘আমাদের গ্রামে একটা হাইস্কুল হয়েছে জান’জয়রাম বেশ আনন্দের সঙ্গে বলল।
‘জানি। আমি একদিন ওদিকে যাবার সময় ভেতরে ঢুকেছিলাম। আমাদের সময় হলে এত কষ্ট করে পড়তে হত না।’
‘তুমি তো তাও যেভাবেই হোক পড়াশোনা করেছ।আমার তো পাঠশালাতেই সব শেষ। আজকাল গ্রামের ছেলে মেয়েরা বাড়ির সামনে পড়াশোনা করতে পারছে।’
সময় কাটানোর জন্য আমরা আরও নানা ধরনের কথা বললাম। মাঝখানে একজন টি.টি. ই উকি দিয়ে দেখেছিল। হয়তো আমাকে দেখেই চলে গেল।আমাদের সঙ্গে্র ছেলেরা কোথায় কী করছে ,গ্রামের কোথায় নতুন রাস্তা ঘাট আর পুকুর হয়েছে,কে কে গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার হয়েছে সেসব কথা জয়রাম একাধারে বলে গেল। কিন্তু নিজের পারিবারিক কথা বড় বেশি বলল না,কেবল কথা প্রসঙ্গে বলল যে গ্রামটির যদিও উন্নতি হয়েছে বামুন চকের (জয়রামদের অঞ্চল) বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। কথাগুলি অবশ্য সে হালকা ভাবেই বলে গেল।
আমরা স্টেশনে পৌছে গেলাম। জয়রাম বলল,অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লেগেছে।গ্রামের বাড়িতে কখন ও এলে আমারদের বাড়িতেও একবার দেখা করে যেও,তোমরা বড় মানুষ হয়ে গেছ,তা বলে আমরাও তো শৈশবে বন্ধু ছিলাম।’
আমি কথা দিলাম,সময় পেলেই আমাদের বাড়ি আসব,অবশ্য গ্রামে এখন আর আমার আপন বলতে কেউ নেই,তবু শৈশবের অনেক পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হবে।
বিদায় নেবার সময় জয়রাম কেমন যেন দ্বিধান্বিত বলে মনে হচ্ছিল।
‘কিছু বলবে নাকি জয়রাম?’আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘না কিছু না,এখন যাও।অন্য কোনো সময় দেখা হলে বলব।’
আমরা ছাড়াছাড়ি হলাম। জয়রাম গ্রামের দিকে চলে গেল। আমার জন্য থানা থেকে স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়েছিল। তখনও ভোর হয়নি।আমার বেশ ভালো ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। কেউ একজন চিৎকার করে করে জাগিয়ে দিল। এই বিষয়ে আমরা অভ্যস্থ। কোনো পুলিশই শান্তিতে ঘুমোতে পায় না। আমাদের দিন রাত বলে কিছু নেই।
চোখ কচলাতে কচলাতে বিরক্তির সঙ্গে উঠে এলাম। দরজা খুলে বাইরের দিকে তাকালাম। সদ্য ভোর হয়েছে। একজন কনস্টেবল সেলাম জানাল।
‘স্যার’।
‘কী হয়েছে?’
‘সুইসাইড কেস স্যার।’
মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল বেলাতেই সুইসাইড কেস।
‘কোথায়?’
কনস্টেবল সংক্ষেপে জানাল।
‘মরা মানুষ কি আর দৌড়ে পালাবে ,সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে কী দোষ হত?’
কিন্তু কথাগুলি বলেই নিজেই ভাবলাম সুইসাইড কেস যখন একটা তদন্ত করতে হবে,না হলে মৃতদেহ সৎ্কার করতে পারবে না। তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়াই ভালো। কিন্তু থানায় আগের দিনের কিছু কাজ ও ছিল। সেগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে চা-টা খেয়ে বেরোতে বেরোতে ছয়টা বেজে গেল।
জিপ নিয়ে সঙ্গে দুজন কনস্টেবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দিন দিন সুইসাইড কেসের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষগুলি আজকাল বেঁচে থাকার কোনো রসদ পাচ্ছে না বলে মনে হয়। কে জানে কেন? একটা স্বাধীন দেশে মানুষগুলি এভাবে অধৈর্য আর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়াটা কিন্তু ভালো কথা নয়। রাস্তার পাশে জিপটা রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। একটা পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে । ঘটনাস্থলে জিপ নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভালো পথঘাট নেই।
আমাদের দেখে কয়েকজন মানুষ আমাদের দিকে এগিয়ে এল। এটি আমার পরিচিত গ্রাম। এখানকার অনেক মানুষই একসময় আমার পরিচিত ছিল। এর আশেপাশেই আমার শৈশব কেটেছে।আমাদের নিজের বসত বাড়িটাও এখান থেকে এক মাইলের বেশি হবে না।
খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। পথ-ঘাট নতুন হয়নি। পথের পাশে বাড়ি-ঘর গুলিও আগের মতোই রয়েছে। একটাও টিনের বা পাকা ঘর নতুন করে বানানো হয়নি। ঘাট ভেঙ্গে পড়া পুকুরটার ঘোলা মলিন জল এখন ও আগের মতোই রয়েছে। ঘরের বারান্দার লোভী ছাগল,সামনের ক্ষীণ গরু আগের মতোই রয়েছে।ক্ষীণ অবয়বের মলিন ছেলে-মেয়েগুলি ওদের চোখের সরল বিস্মিত চাহনি এবং একে অপরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলা কথা –সব কিছুই আগের মতোই থেকে গেছে। সমগ্র দেশে এত পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এই বামুণচকে আজও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। সমগ্র গ্রামটাই যেন মৃত। আমি বিরক্ত অনুভব করলাম।
‘মৃতদেহটা কোথায় আছে?’আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসা লোকগুলির দিকে তাকিয়ে বললাম।
‘ঐ জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে। বাঁশবনের কাছে।’
‘প্রথমে ওখানে গিয়ে দেখে আসি স্যার’,একজন কনস্টেবল বলল। আমরা মৃতদেহ যেখানে রয়েছে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
হালকা জঙ্গল,দুয়েকটা আম,জাম গাছ রয়েছে। ততক্ষণে রোদ চলে এসেছে তবু জঙ্গলটাকে গভীর বলে মনে হল।
আঁকাবাঁকা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে আমরা কিছুটা ফাঁকা জায়গায় উপস্থিত হলাম।
‘এই যে স্যার’আমাদের থেকে একটু দূরে মাটিতে পড়ে থাকা মৃতদেহটা দেখিয়ে একজন মানুষ বলে উঠল।
এরকম দৃশ্য দেখায় অভ্যস্থ হলেও ,শবটা দেখে আমর শরীর শিউরে উঠল।
‘আমার সামনে প্রায় উলঙ্গ একটা মানুষের শবদেহ পড়ে রয়েছে। মাথায় দীর্ঘ কালো চুল,একটা ক্ষীণ কালো মুখ কিছুটা হা করে রয়েছে।’মুখটা কিছুটা হা করে রয়েছে। জিভটা মুখের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাতে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। তাকিয়ে থাকা চোখদুটি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেহে প্রাণ নেই যদিও চোখজোড়া যেন এখন ও তাকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। একজোড়া কোমল বিষণ্ণ তীব্র চাহনি। চোখদুটির দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম। শবের শরীরে কোনো কিছু নেই,ক্ষীণ,মেরুদণ্ডের হাড়গুলি একটা একটা করে গণা যাচ্ছে। পেট আর পিঠ লেগে গেছে। কোমরে এক টুকরো পুরোনো গামছা। পাশেই একটা গরু বাঁধার দড়ি পড়ে রয়েছে।
একজন মাটি থেকে দুহাত ওপরের একটা গাছের ডালের দিকে দেখিয়ে বলল ,ঐ গাছের দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিল,শেষ রাতের দিকে মারা গেছে,মানুষ ভোরবেলা দেখেছে।
দুই একটা কথা জিজ্ঞেস করে কেসটা যে আত্মহত্যাই,কেউ হত্যা করেনি সেই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম,শবটা ফেলে না রেখে তাড়াতাড়ি দাহ করার পরামর্শ দিলাম,প্রয়োজনীয় বিবরণ আমি টুকে নিলাম।
জঙ্গলের মধ্যের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এসে আমি লোকজনের সঙ্গে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।বাগানটাতে বেড়া নেই।উঠোনটা আগাছায় ভরে আছে।ঘরটা জরাজীর্ণ।বেড়া-চালগুলি খসে পড়া,মাঝে মধ্যে চালের কামি বেরিয়ে পড়েছে।ঘরটা এমনিতেই নিচু,ঘর না বলে একে ঝুপড়ি বলাই সঙ্গত।
চারপাশটা একেবারে নীরব,নিস্তব্ধ।একটা করুণ বিষাদ যেন চারপাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে।আমি যদিও পুলিশের মানুষ আমার মনটা দমে গেল।গ্রামটাকে যেন অদৃশ্য মরণ চারপাশ থেকে চেপে ধরেছে।এখানে প্রবেশ করলেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
তবু আমাকে আমার কর্তব্য করতে হবে।আত্মহত্যা সম্পর্কীয় আবশ্যকীয় তদন্ত না করলে তো চলবে না।এই ঘরেই মানুষ—
আমি পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিক ওদিক থেকে দুই একটা মানুষ এসে জমা হল,ঘরের ভেতর থেকেও দুয়েকটি ছেলে মেয়ে বেরিয়ে এল।একজন পূর্ণ যুবতি উঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ঘরের মূল মানুষটার খোঁজ করলাম। আসবে,অল্প সময়ের জন্য কোথাও গেছে।আমার সামনে বসা একজন বয়স্ক মানুষকে আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণটা বলতে পারে নাকি জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি সহজভাবে বললেন,’কারণ আর কি জিজ্ঞেস করবেন স্যার।আমাদের এই বস্তিতে একঘর মানুষের ও খাবার নেই।বামুন মানুষ,নিজেরা চাষ বাস করতে পারি না,জমিও নেই।যজমানি করে,শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ করে কি আজকের দিনে আর একটি পরিবার চলতে পারে?
আমি বুঝলাম মানুষটা বেশি কথা বলে।বললাম,‘সেসব বুঝলাম।কিন্তু ছেলেটি কেন আত্মহত্যা করল কিছু জানেন কি?’
তিনি বললেন, ‘জানার আর কি আছে।আরও কিছুদিন এভাবে চললে সবাই আত্মহত্যা করবে।’
‘কেন?’
মানুষটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলল ‘স্যার,তেরো বছরের ছেলে।ক্লাস সেভেনে পড়ত।পড়া আর কোথায়?বইপত্র নেই,কাপড়-চোপড় নেই,ফিস দিতে পারে না।এদিকে বাড়িতে খাবার নেই।’
‘ছেলেটি ক্লাস সেভেনে পড়ত?’
‘হ্যাঁ স্যার,ছেলেটি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল।এর মধ্যেই প্রতিবছর প্রমোশন পেয়ে যেত।কিন্তু সে গত পাঁচ মাসের ফিস দিতে পারেনি।কী করবে,বাবার এক পয়সা রোজগার নেই,মাস্টার কিছুদিন অপেক্ষা করলেন।গতকাল তার নাম কেটে দিয়েছেন।পাঁচদিন হল,বাপ বড় ছেলের কাছে গিয়েছিল।সে কোথাকার এক মুহুরির বাড়িতে রাঁধুনি।এরা সবাই অপেক্ষা করছিল বাবা বড় ছেলের কাছ থেকে টাকা পয়সা,ধান-চাল নিয়ে ফিরবে,এভাবে দুদিন তো তাহলে চলবে।কিন্তু বাপ ফিরে এলো না।তিনদিন ধরে বাড়িতে একটা খুদ-কণা নেই।ছেলেটি এ বাড়ি ও বাড়ি এক মুঠো চালের খোঁজে ঘুরে বেড়াল।কিন্তু কার এমন পর্যাপ্ত আছে যে দেবে?সেই ছেলেটিই বা আর কতদিন পেটের ক্ষুধা সহ্য করবে?তবু পিতার আসার অপেক্ষায় খালি পেটে পড়ে রইল।বিকেলের দিকে বাবা ফিরে এল।কিছুই নেই।যেভাবে গিয়েছিল সেভাবেই ফিরে এসেছে,না টাকা পয়সা,না ধান চাল কিছুই পায় নি।
‘এখন বাপ কোথায়?’
আমার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে একজন মানুষ আমার সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।মুখটা বিবর্ণ,চোখ দুটি গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে।গালে এক মুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি।মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম।কবে কোথায় যেন মানুষটাকে দেখেছি।মানুষটার মুখটা আশ্চর্যরকম ভাবে শুকনো,যেন সে বেশ কিছুদিন আগুনের কাছে বসেছিল,এই মাত্র উঠে এসেছে।তার নীরস ঠোঁটদুটি সাদা হয়ে গেছে।
মানুষটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইল বলে মনে হল।কিন্তু সে যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না।হয়তো তার জিহ্বা,গলা,সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করে যেন সে নীরস,আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,’ও তুমি রামেশ্বর,ভালোই হল তুমি এসেছ’।
হঠাৎ গলার স্বরে তাকে চিনে ফেললাম।জয়রাম।কিন্তু এক রাতের মধ্যে তার এত পরিবর্তন হল কীভাবে?আমি প্রায় হতভম্ব হয়ে গেলাম।
কোনোমতে বললাম,’জয়রাম না?তুমি এখানে?’
জয়রাম সহজ হওয়ার চেষ্টা করল আর বলল,এখানে না হলে আর কোথায় যাব,এটাই আমার ঘর।যাকে দেখলে সে আমারই ছেলে।’
‘কী?’আমি বিস্মিতভাবে জয়রামের মুখের দিকে তাকালাম।জয়রাম কিছুটা শান্তভাবে বলল,‘আমার কথা তো তোমাকে কাল বলেছিই।কয়েকমাস ছেলেটির ফিস দিতে পারিনি।খাবার ও নেই।বড় ছেলের কাছে গিয়েছিলাম,দুটো পয়সা আনব বলে।তবে সে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে।তার হাতেও কিছুই নেই।চলে এলাম।রেলে আসার মতো পয়সা ছিল না।তোমার সাহসে এলাম।এখানে ওরা সবাই আমার পথ চেয়ে বসেছিল,কিছু না হলেও হয়তো এক বেলার খাবারটা নিয়ে আসব।তবে ভিক্ষা ছাড়া কোথা থেকে আনব?আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে কেউ কিছু বলল না।আগেও অনেকবার এভাবে এসেছি।তোমার কাছে একটা টাকা চাইব বলে ভেবেছিলাম।কিন্তু পারলাম না। ছেলেমেয়ে গুলির পেটে গত তিনদিন একটা দানাও পড়েনি।ও আর কী করবে।স্কুলেও নাম কাটা গেছে।খাবার নেই,রাতে বেরিয়ে গিয়ে গাছের ডালে ঝুলে পড়ল।‘
কথাগুলি জয়রাম এত শান্তভাবে বলল যে আমার বিশ্বাস করতে অসুবিধা হল যে কথাগুলি সেই বলছে।আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।হয়তো সে সারা রাত কেঁদেছে।তাঁর চোখে আর জল নেই।কিছুটা ধৈর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম,‘আত্মহত্যা করা ছেলেটি তাহলে তোমারই?’
হঠাৎ জয়রামের চোখের দুকোণ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল।সে শুকনো মুখটা বিকৃত করে কান্না চেপে ধরার চেষ্টা করল এবং কিছুক্ষণ পরে বলল ‘ছেলেটি নিজে ফাঁস লাগিয়ে মরেনি।আমিই তার গলা টিপে ধরে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম বলে রিপোর্ট করলে আমাকে ফাঁসি দেবে কি?’
আমি এবার জয়রামের মুখের দিকে তাকালাম। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকার শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আস্তে করে আমি বললাম,‘আমি এখন যাই জয়রাম।’
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি জয়রামদের বস্তি থেকে বেরিয়ে এলাম।
লেখক পরিচিতি:
অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম রূপকার সৈয়দ আব্দুল মালিক ১৯১৯ সনে অসমের শিবসাগর জেলার নাহরণিতে জন্মগ্রহণ করেন।যোরহাট সরকারি হাইস্কুল থেকে পাশ করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম.এ করেন।পরবর্তীকালে যোরহাট জেবি কলেজে অধ্যাপনা করেন।লেখকের গল্প সঙ্কলন গুলির মধ্যে ‘পরশমণি’,শিখরে শিখরে’,‘শুকনো পাপড়ি’বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।‘অঘরী আত্মার কাহিনী’উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।