তরবারির ছাঁদ
লোকটার আসল নাম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই; তাকুয়ারেমবো-তে সকলের কাছেই ও হচ্ছে, “লা কোলোরাডা-র ইংরেজ”। জমির মালিক কারডোসো প্রথমে জমিটা বেচতে চায়নি; শুনেছি এই ইংরেজ তাকে এমন এক যুক্তিতে কাবু করে ফেলে যা কারুর কল্পনাতেই আসেনি কখনো—লোকটা ওকে ওই কাটা দাগটার গোপন ইতিহাস জানিয়ে দেয়। বর্ডারের দিক থেকে এসেছিল লোকটা, রিও গ্র্যান্দে দো সুল থেকে; কা’রা যেন বলেছিল যে ব্রাজিলে থাকতে লোকটা ছিল স্মাগলার, চোরাচালানকারী। জমি ঘাসে ছেয়ে ফেলেছে, জল তিতকুটে; সেসব ঠিকঠাক করে তুলতে আজ্ঞাবহদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করেছিল লোকটা। লোকে বলে, লোকটা নাকি ছিল এমন কঠোর যে নিষ্ঠুরই বলা যায়, কিন্তু ভরসা রাখার মত ন্যায়পরায়ণ। মদ খেতে যে ভালোবাসত সেকথাও বলত লোকে; বছরে একবার কি দু’বার বাড়ির মধ্যে একটা ঘরে ঢুকে পড়ে দরজায় আগল দিয়ে দিত, তারপর দুই কি তিনদিন পরে যখন বেরিয়ে আসত, মনে হত যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরল কিংবা একটা আধা অচৈতন্য ঘোরের মধ্যে যেন ছিল—কেমন ফ্যাকাসে, কাঁপুনি দিচ্ছে, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া, আর যথাপূর্ব দাপুটে। ওর সেই হিমশীতল চাহনি, একটু নির্জীব ভাব, কাঁচাপাকা গোঁফ আমার মনে আছে। কেমন যেন একাচোরা লোক একটা; আসলে স্প্যানিশটা জানত নামমাত্রই, তার ওপর ব্রাজিলের লোকেদের উচ্চারণ দোষে দুষ্ট। ব্যবসা সংক্রান্ত দু’একটা চিঠি আর বিজ্ঞাপনের প্যামফ্লেট ছাড়া ওর কাছে তেমন চিঠিপত্রও আসত না।
শেষ যেবার উত্তরাঞ্চলের ভেতর দিয়ে কোথাও যেতে হয়েছিল, সেবার সারাগাতায় জলস্ফীতি হয়ে আমাকে একটা রাত কাটাতে হয়েছিল লা কোলোরাডাতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মনে হল যেন টের পাওয়া যাচ্ছে যে এভাবে এসে হাজির হওয়াটা ঠিক যুতসই হয়নি। ইংরেজের সঙ্গে খানিক হৃদ্যতা সৃষ্টির চেষ্টা করে দেখতে কিঞ্চিত দেশপ্রেমের আশ্রয় নিয়ে দেখলাম, যেটাতে মেতে উঠতে কিছুই খুব একটা খতিয়ে দেখার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। ইংল্যান্ডের মত উচ্চ মানসিকতার দেশকে যে দমিয়ে রাখা যায় না এমন একটা মত প্রকাশ করলাম। শ্রোতা মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিলেন, কিন্তু তারপর একটু হেসে বললেন যে উনি ইংরেজ নন—উনি আইরিশ, বাড়ি ডাংগারবান। বলে চুপ করে গেলেন, যেন কী একটা গোপন কথা ফাঁস করে ফেলেছেন।
ডিনারের পরে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম, খোলা আকাশে চোখ রাখব বলে। মেঘ সরে গেছে, তবে দূরে পাহাড়ের তীক্ষ্ণ চূড়াগুলোর ওধারে দক্ষিণের আকাশ চিরে চিরে দিচ্ছিল বিদ্যুতের রেখা, যেন ফাটল ধরেছে। আবার আরেকটা ঝড়ের সম্ভাবনা। জরাজীর্ণ ডাইনিং-রুমে ফিরে এলাম, যে পরিচারক ডিনার পরিবেশন করছিল, সে এক বোতল রাম নিয়ে এলো। দীর্ঘ সময় ধরে মদ্যপান চলল, নিঃশব্দে।
কখন যেন একসময়, বুঝতে পারলাম যে আমার নেশা হয়ে গেছে; ঠিক কোন প্রেরণায় কিংবা উল্লাসে অথবা একঘেঁয়েমিতে আক্রান্ত হয়ে যে গৃহস্বামীর সেই কাটা দাগ নিয়ে কিছু একটা বলে ফেলেছিলাম তা আর এখন বলতে পারি না। ওঁর মুখটা পাথরের মত হয়ে উঠলো; বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে মনে হচ্ছিল, হয়তো আমাকে এবারে বের করে দেবে। কিন্তু শেষ অবধি, খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে, তিনি বললেন:
“এই কাটা দাগটার কাহিনী আমি আপনাকে বলব, তবে একটা শর্তে—কোনোরকম ঘৃণার উদ্রেক হলে, বা কোনও কিছুকে নিন্দনীয় বলে মনে হলে, তা চেপে রাখার দরকার হবে না, কোনোরকম অভব্যতাকে সুরুচির আবরণে সহনীয় করে তুলতে বলা হবে না।”
আমি রাজি।এবারে ইংরেজির সঙ্গে স্প্যানিশ মিশিয়ে, কখনো এমনকি পর্তুগিজও, যে কাহিনী উনি পেশ করলেন সেটাই এখানে বলছি:
১৯২২ সাল নাগাদ, কনাউট-এর কোনো একটা শহরে যে বহুসংখ্যক যুবা আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন করার মতলব আঁটছিল, আমি ছিলাম তাদেরই একজন। সেখানে যারা আমার সঙ্গী ছিল, তাদের অনেকেই এখনও জীবিত, শান্তি আনার চেষ্টা করছে এখন; অন্যেরা, ভাবলেও আশ্চর্য লাগে, সমুদ্রে কিংবা মরুভূমিতে ইংল্যান্ডের হয়ে লড়াই করছে; যেটি ছিল আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠজন, একদিন খুব ভোরে জেলখানার প্রাঙ্গণে তাকে গুলি করে মারা হয়,যারা কাজটা করেছিল, তাদেরও স্বপ্নের খামতি ছিল না; এছাড়া অন্যেরা (তাদের দুর্ভাগ্যও কিছু কম নয়)যে যার ভাগ্যের মুখোমুখি হয়েছিল গৃহযুদ্ধের নানা অজানা, গোপনই বলা যায়, রণক্ষেত্রে। আমরা ছিলাম রিপাবলিকান এবং ক্যাথলিক; আমার এখন ধারণা, আমরা ছিলাম রোম্যান্টিক। আমাদের কাছে যে আয়ারল্যান্ড মানে নেহাতই একটা অসহ্য বর্তমান আর স্বপ্নময় আদর্শ ভবিষ্যতই ছিল, তা নয়, ছিল একটা তিক্ত অথচ প্রিয় পৌরাণিক কাহিনী যেন বা, গোল পরিধির টাওয়ার আর লালচে কাদামাটি, পারনেলের অস্বীকার-বার্তা, আয়ারল্যান্ড মানে ছিল বলীবর্দ অপহরণের গীতিকা যেসব মহাকাব্য, পূর্বজন্মে যে বলীবর্দ ছিল কোনও বীর, আর তারও আগের জন্মে মৎস্য, পর্বত… এক সন্ধ্যেয়, আমার চিরকাল মনে থাকবে, আমাদের কাছে এসেছিলেন একজন, আমাদেরই লোক, মুনস্টার থেকে—তাঁর নাম জন ভিনসেন্ট মুন।
কুড়ির বেশি বয়েস হওয়ার কথা নয়। রোগা পাতলা চেহারা, কিন্তু পেশিগুলো শিথিল, হঠাৎ দেখলে—কেমন যেন অস্বস্তিকর, অমেরুদণ্ডী প্রাণী বলে মনে হয়। বিশ্বস্তভাবে এবং খানিক গর্ব সহকারেই তিনি কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর প্রায় প্রতিটি পাতাই পড়েছেন। যেকোনো বিতর্কে ডায়ালেকটিক মেটিরিয়ালিজম দিয়ে বাকি সব কিছুকে উড়িয়ে দিতে পারেন বেশ প্রতাপের সঙ্গে। একজন মানুষের অসংখ্য কারণ থাকতে পারে অন্য একজন মানুষকে ঘৃণা কিংবা পছন্দ করার; কিন্তু পুরো জগতের ইতিহাসটাই স্রেফ অতি অবাঞ্ছিত ও নিন্দনীয় এক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয়েছে মুনের কাছে।ঘোষণা করলেন যে বিপ্লবের জয় এক পূর্বনির্ধারিত অনিবার্যতা। আমি উত্তরে বললাম যে উন্নত মানুষের কিন্তু যাবতীয় মাথাব্যথা, যেসব আদর্শ পরাজিত হয়েছে সেগুলো নিয়েই হওয়ার কথা…রাত হয়ে গিয়েছিল, আমরা আমাদের এই দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে করিডর ধরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম, নেমে এলাম রাস্তায় কোথাও একটা। যে গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে অবিসংবাদিত সত্য হিসেবে সে একের পর এক রায় দিয়ে যাচ্ছিল বিভিন্ন ব্যাপারে, আমি মোটেই ততটা মূল্য দিচ্ছিলাম নাসেগুলোকে। এই সদ্য আগত কমরেড ঠিক বিতর্কে জড়ায় না, যুক্তিও দেয় না—সে কেবল বিচারকের রায় ঘোষণা করে, সবকিছুকে নস্যাৎ করে, এবং খানিকটা যেন আক্রোশের সঙ্গেই।
সেই রাতে শহরের একবারে প্রান্তের বাড়িঘরের কাছে যখন এসে পড়েছি, হঠাৎ গুলিগোলার আওয়াজে আমরা থমকে গেলাম। (এর আগে, এবং পরেও, আমরা যাচ্ছিলাম কোনও ফ্যাক্টরির কিংবা জেলখানার উঁচু পাচিলের ধার দিয়ে দিয়ে)। ঘুরে চলে গেলাম একটা মাটির রাস্তায়; আলোর ঝলকের মধ্যে এক সৈনিক দেখি একটা অগ্নিদগ্ধ কুঁড়ের থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে আমাদের থামতে বলল। আমি গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকলাম; কিন্তু আমার কমরেড আমার সঙ্গে এল না। পেছন ফিরলাম— হেডলাইটের আলোতে জন ভিনসেন্ট মুন দেখি খরগোসের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে—চিরকাল যেন ঐভাবে ছিল, আতঙ্কে। দৌড়ে গিয়ে এক ঘুঁষিতে সেই সৈনিককে মাটিতে পেড়ে ফেলে, ভিনসেন্ট মুনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলাম, ধমক দিয়ে আদেশ করলাম আমার সঙ্গে আসতে। হাত ধরে টেনে আনতে হল; ভয়ের চোটে মনের জোর একেবারে হারিয়ে ফেলেছে। তারপরে অবশ্য দু’জনেই দৌড় দিলাম—বিধ্বংসী আগুনে ছেয়ে ফেলা সেই রাতে আমরা তার মধ্য দিয়ে পালালাম। এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল আমাদের লক্ষ্য করে, মুনের ডান কাঁধ ছুঁয়ে চলে গেল একটা বুলেট; পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে যখন পালাচ্ছিলাম, একটা অস্ফুট ফোঁপানি ওর বুক মুচড়ে বেরিয়ে এল।
১৯২২ সালের শরৎকালটা আমি মোটামুটি আত্মগোপন করেই কাটাচ্ছিলাম, আস্তানা ছিল জেনারেল বার্কলের গ্রামের বাড়ি। বেঙ্গলে কোনও একটা প্রশাসনিক দায়িত্ব তখনকার মত ন্যস্ত হয়েছিল জেনারেলের ওপর (আমি তাঁকে কখনো সাক্ষাৎ দেখিনি); বাড়িটার বয়েস তখনও একশো বছরও হয়নি, কিন্তু তখনই কেমন যেন বিষাদময়, জরাজীর্ণ অবস্থা, আর সারা বাড়ি জুড়ে ধাঁধা লাগানো সব করিডর আর উদ্দেশ্যহীন সব ঘর-সংলগ্ন কুঠুরি। মিউজিয়াম-ক্যাবিনেট আর বিশাল লাইব্রেরি দখল নিয়ে নিয়েছে পুরো নিচের তলাটার—বিতর্ক জাগানো অথচ একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও মিল নেই এমন সব বই সেখানে, কোনোভাবে সেগুলোই উনবিংশ শতকের ইতিহাস; নিশাপুরের তরবারি বেশ কয়েকটা, ওদের হিমশীতল বঙ্কিম ছাঁদে এখনো সব ঝড় তোলা হিংস্র যুদ্ধেরা যেন জীবিত রয়ে গেছে। আমরা পেছন দিক দিয়ে বাড়িটাতে ঢুকেছিলাম বলেই যেন মনে পড়ছে। মুন তখনও কাঁপছে, শুকনো মুখে বিড়বিড় করে বলল যে সে রাতে যা কিছু ঘটল, সেগুলো নাকি “ইন্টারেস্টিং” ; ওর ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিয়ে খানিক উপশম যোগানোর চেষ্টা করলাম, তারপর এক কাপ চা করে এনে দিলাম। ক্ষত আদৌ গভীর নয়। হঠাৎই, ধন্দে পড়ে গিয়ে, তুতলে বলে উঠলো :
“আপনি কিন্তু ভয়ানক ঝুঁকি নিয়েছিলেন একটা, আমাকে বাঁচাতে ওভাবে ফিরে এসে।”
আমি বললাম যে ও কিছু নয়। (গৃহযুদ্ধে অমনটাই আদতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বলেই ওরকম করে ফেলেছিলাম; তাছাড়াও, যেকোনো একজন ধরা পড়ে গেলেই আমাদের উদ্দেশ্যটারই বড় ক্ষতি হতে পারত।)
পরদিন মুন অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে উঠল। আমার থেকে একটা সিগারেট নিতে রাজি হয়ে গেল এবং “আমাদের বিপ্লবী সংগঠনের আর্থিক সংগতি” বিষয়ে আমাকে কঠোরভাবে জেরা করতে শুরু করল। প্রশ্নগুলো খুবই সহজ : আমি ওকে জানালাম (অকপটে) যে পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন। গোলাগুলির সুগভীর গর্জন দক্ষিণের শান্তিকে বিঘ্নিত করে তুলেছে। মুনকে বললাম যে আমাদের সঙ্গী-সাথীরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমার ওভারকোট আর রিভলবার ওপরে আমার নিজের ঘরে ; ফিরে এসে দেখি, মুন সোফার ওপর শোয়া, চোখ বন্ধ। ওর মনে হচ্ছে যে ওর জ্বর এসেছে ; বলল যে কাঁধে নাকি ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে।
এতক্ষণে আমি টের পেলাম যে ও হচ্ছে একটি অপদার্থ কাপুরুষ। কোনওরকমে ওকে নিজের যত্ন নিতে বলে,আমি বেরিয়ে এলাম। মানুষটা আর তার ওই ভয় দেখে আমি নিজেই বিব্রত বোধ করছিলাম, লজ্জা হতে লাগল, যেন আমি নিজেই সেই কাপুরুষ, ভিনসেন্ট মুন নয়। একজন একটা কিছু করে বসলে, গিয়ে দাঁড়ায় যেন সবাই মিলে করেছে। এই কারণেই, সেই যে একজন লোক একবার একটা বাগানে নিষেধ মানল না আর তার ফলে পুরো মানবজাতিটাই দূষিত হয়ে গেল, সে তেমন অন্যায্য কিছু নয়; একই কারণে, মাত্র একজন ইহুদি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যে সেই মানবজাতিকে রক্ষা করল, তাতেও অন্যায্য কিছু নেই। শোপেনহাওয়ার সম্ভবত ঠিকই বলেছিলেন—আমিই সেই অপর সমস্ত লোক, যেকোনো লোকই মানবজাতি। কোনোভাবে শেক্সপিয়ারই সেই নরাধম জন ভিনসেন্ট মুন।
জেনারেলের সেই অনন্যসাধারণ বাড়িটায় আমরা ন’দিন কাটালাম। যুদ্ধময় সেই আঁধারে আলোকরেখা অথবা তার যন্ত্রণার দিক নিয়ে এখানে কিছু বলছি না ; আমি বলতে চাইছি, কলঙ্ক হয়ে চেপে বসে থাকা এই কাটা দাগটার কাহিনী। আমার স্মৃতিতে সেই ন’টা দিন যেন একটাই দিন হয়ে রয়েছে— কেবল, পরদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত আমাদের লোকেরা একটা ব্যারাকে চড়াও হয়ে, এলফিনে মেশিন গানের গুলিতে আমাদের যে ষোলোজনের প্রাণ গিয়েছিল, একটি একটি করে সেই প্রতিটি মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল। খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম, প্রথম ঊষার সেই ঝাপসা আলো অন্ধকারে। রাতের দিকে ফিরে আসতাম। আমার সঙ্গীটি ওপর তলায় আমার জন্য অপেক্ষা করত ; ক্ষত নিয়ে নেমে আসা যায় না। ওর হাতে কতগুলো স্ট্র্যাটেজির ওপর বই দেখতাম বলে যেন মনে পড়ছে—এফ এন মোদ, কিংবা ক্লাউসভিচ। একরাতে ও আমাকে বলেই ফেলল, “আমার পছন্দের অস্ত্র হচ্ছে কামান।” আমাদের প্ল্যান সম্বন্ধে জানতে চাইত; সেগুলোর সমালোচনা করতে কিংবা ওগুলোই পুনর্বিবেচনা করতে ভালো লাগত ওর। ‘আমাদের শোচনীয় আর্থিক সংগতি’ নিয়ে নিন্দা করত খুব; অনমনীয়ভাবে গাম্ভীর্য সহকারে একটি বিপর্যয়কর শেষ পরিণতির ভবিষ্যতবাণী করত। অস্ফুটে বিড়বিড় করে বলতে শোনা যেত, “সে উন অ্যাফেয় ফ্লঁবি”। শারীরিকভাবে সে একটি কাপুরুষ, অথচ এতে যে তার কিছুই এসে যায় না সেটা প্রতিপন্ন করতেই ভয়ানক মানসিক ঔদ্ধত্য দেখাতে থাকত। ভাল কি মন্দ যেভাবেই হোক, এভাবেই কেটে গেল ন’টা দিন।
দশম দিনে শহরের পতন হল কৃশাঙ্গ ও গাঢ় গাত্রবর্ণদের হাতে, চিরদিনের মত। উচ্চাসনে বসে অশ্বারোহীরা বীটে ঘুরতে থাকলো, মুখে কথাটি নেই; বাতাসে ছাই আর ধোঁয়া উড়ছে। এককোণে দেখলাম একটা মৃতদেহ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে—কিন্তু সেই মৃতদেহ স্মৃতিতে তত স্পষ্টভাবে নেই, যতটা কিনা আছে সেই ডামিটা, শহরের কেন্দ্রে এক চত্বরে যেটাকে ব্যবহার করে সৈনিকরা লক্ষ্যভেদ অভ্যাস করেই যাচ্ছিল অবিরাম… আকাশে ভোরের আলো যখন সবে একটু একটু করে ফুটছে, আমি একটু বেরিয়েছিলাম; দুপুরের আগেই ফিরেও এসেছিলাম। মুন তখন লাইব্রেরিতে, কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল; কথা বলার ধরণ থেকে বুঝলাম যে টেলিফোনে কথা বলছে। তারপর আমার নামটা শুনতে পেলাম; তারপর শুনলাম যে আমি সন্ধ্যে সাতটায় ফিরব, আর তারপরে, আমি যে লন পার হলেই গ্রেপ্তার হব সেটাও। আমার যুক্তিবাদী বন্ধুটি, আমাকে যুক্তিযুক্তভাবেই ধরিয়ে দিতে চলেছে। শুনতে পেলাম, ও নিজের নিরাপত্তার আশ্বাস চাইছে।
এইখানে আমার গল্পটা একটু দিশেহারা হয়ে আর এগোতে পারছে না। এটুকু জানি যে আমি খোঁচড়টাকে তাড়া করে গিয়েছিলাম সেইসব দুঃস্বপ্নময় অন্ধকার করিডর ধরে, মাথা ঘুরে যাওয়ার মত খাড়াই সিঁড়ি দিয়ে। বাড়িটার প্রতিটি ইঞ্চি ভালই চিনত মুন, আমি যতটা চিনতাম ততটাই। দু একবার আমার চোখ এড়াতে পেরেছিল, কিন্তু সৈনিকরা এসে আমাকে গ্রেপ্তার করার আগেই আমি ওকে কোণঠাসা করে ফেললাম। জেনারেলের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে একটা তরবারি নিয়ে এসে সেই বাঁকা ইস্পাতখন্ডটি দিয়ে ওর মুখের ওপর চিরকালের জন্য একটি চিহ্ন এঁকে দিলাম—রক্তাক্ত আধখানা চাঁদের আদলে। একমাত্র আপনাকেই বললাম এটা বোর্হেস—নেহাতই অচেনা লোক আপনি। আপনি ঘৃণা করতে শুরু করলে সেটা তত বেদনাদায়ক হবে না।
কাহিনীকার এখানে এসে থামলেন। দেখলাম, ওঁর হাতদুটো কাঁপছে।
“আর মুন?” আমি জানতে চাইলাম। “মুনের কী হল?”
“জুডাস তার মুদ্রা বুঝে পেয়েছিল, সে তারপর ব্রাজিলে পালিয়ে গেল। শহরের সেই চত্বরে, সেই সন্ধ্যেয়, মদে চুর এক ফায়ারিং স্কোয়াডকে দেখলাম একটা ডামিকে গুলি করতে।”
গল্পের বাকিটুকুর জন্য ব্যর্থ অপেক্ষায় থেকে, শেষটায় আমিই পরেরটুকু বলতে অনুরোধ করলাম।
একটা গোঙানিতে ওঁর সারাটা শরীর কেঁপে উঠল; দুর্বলভাবে ধীরে উনি সেই বাঁকা ফ্যাকাসে ক্ষতচিহ্নটার দিকে নির্দেশ করলেন।
“আমাকে বিশ্বাস করছেন না ?” বলতে গিয়ে একটু তোতলালেন। “মুখের ওপরে আমার সেই পাপের চিহ্ন চোখে পড়ছে না ? কাহিনীটা এভাবে বললাম, যাতে আপনি পুরোটা শোনেন। আমিই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম আমার সেই রক্ষাকর্তার প্রতি, যে আমায় আশ্রয় দিয়েছিল—আমিই সেই ভিনসেন্ট মুন। নিন, এবারে আমায় ঘৃণা করুন।”