Skip to content

১৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সেলাই আপার শখ থেকে সাফল্য

একটা সময় ছিল, যখন নানা কারণে এদেশের নারীরা ঘরের চার-দেয়ালকেই মাঝে নিজেদের পৃথিবী করে নিতো। ঘরের বাইরের সব কাজ আর দায়িত্ব থেকে এতোটাই দূরে যে, শিক্ষার আলোর সেখানে পৌঁছাতেই বেগ পেতে হয়েছে অনেক। তবে এখন সময় পুরোপুরি ভিন্ন। সমাজের প্রতিটি ধাপে এখন নারী-পুরুষের সমান বিচরণ।

 

নারীদের এই দীর্ঘ সময়ের বন্দীদশা থেকে বের করে এনেছে তাদেরই কিছু সাহসী পদক্ষেপ। প্রতিবারই তারা প্রমাণ করেছে তারাও কোনো অংশে কম নয়। এমনকি এখনো অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাকে সম্মুখীন হতে হয় সহস্র প্রশ্নের আর প্রতিবন্ধকতার। কিন্তু এরপরও কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপেই আপন মহিমায় এদেশের নারীরা আজ প্রতিষ্ঠিত। তেমনি একজন নারী উদ্যোক্তা রুবাবা আকতার। বিবাহিত জীবনে সংসার আর সব দায়িত্ব সামলে এখন তিনি একটি ব্যবসা সফল পোশাক ব্র্যান্ডের সর্বেসর্বা।

 

ছোট থেকেই নতুন ডিজাইনের কাপড় আর সাজসজ্জার শখ ছিল রুবাবা আকতারের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি তাই ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনাও করেন তিনি। তবে কোনো ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে নয়, একান্তই নিজের ভাল লাগা থেকে। এর পরপরই বিবাহিত জীবনে শুরু করেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী আরিফ মোহাম্মদ আবদুস শাকুর চৌধুরীর সাথে। সেখান থেকেই শুরু রুবাবার শখ থেকে স্বপ্ন পূরণের যাত্রা।

 

বিয়ের পর অলস সময়কে কাজে লাগাতে স্বামী আরিফ চৌধুরী প্রেরণা দিতেন রুবাবা আকতারকে। এক সময় শখ ছিল, পরবর্তীতে সে বিষয়ে পড়াশোনাও করা ছিল তার। আর তাই স্বামীর অনুপ্রেরণায় সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি।  অল্প বয়স আর স্বল্প পুঁজি নিয়েই মাঠে নামেন রুবাবা। উদ্দেশ্য, একটা টেইলার আর সেখানেই ডিজাইনিংয়ের প্রাকটিস। একটা সময় পেয়েও গেলেন দোকানের খোঁজ। পিংক সিটি শপিংমলের একটা দোকান। নিজেদের সাধ্যের সবটুকু দিয়েই ভাড়া নিলেন সেই দোকান। তিনটা টেইলারিং টেবিল আর নিজের ডিজাইন করা হাতেগোনা কয়েকটা জামা নিয়ে ২০০৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করলো সেলাই। যাত্রা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই দোকানের সাথে কয়েকটি মেশিনসহ যুক্ত হয় একটি টেইলারিং কারখানা।

 

এভাবেই ধীরে ধীরে পথচলা শুরু রুবাবা আকতারের। আর এই পুরোটা সময়জুড়ে তাকে সাহস দিয়ে গেছেন স্বামী আরিফ চৌধুরী। শুধু তাই নয়, নিজের অফিসের সময়ের বাইরে পুরো সময় ধরেই স্ত্রীকে টেইলারিং, ডিজাইনের, সেলস প্রায় সব কাজেই সাহায্য করেছেন তিনি। প্রায় চার বছর নিজেদের ডিজাইন করা কাপড় বিক্রি করেই বেশ পরিচিতি পায় 'সেলাই'।

 

২০১২ সালে হঠাৎ করেই দেশিও ডিজাইনার কাপড়ের বাজারে দেখা যায় মন্দা। একদিকে মন্দা, অন্যদিকে সন্তান জন্মের এ সময়টাতে ব্যবসার মোড় পাল্টান তিনি। শুরু করেন বাইরের ডিজাইনার পোশাক বিক্রি। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি রুবাবাকে। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে দীর্ঘ এক যুগ পর আজ সেলাই একটি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। রাজধানীর উত্তরা ধানমন্ডি, বনানী আর পিংক সিটিতে রয়েছে সেলাইয়ের চারটি আউটলেট। পাশাপাশি পিংক সিটি শপিং মলে 'কভার গার্ল বাংলাদেশ' নামে রয়েছে আরেকটি শো-রুম।

 

সেলাই আপার শখ থেকে সাফল্য

 

তবে এই সফলতা আর গত এক যুগে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন রুবাবা-আরিফ দম্পতি। ছোট্ট সন্তানকে নিয়েই সামলেছেন টেইলার আর শো-রুম। থান কাপড় নিয়ে সন্তান-কোলে নিজেরাই ঘুরেছেন দোকান থেকে দোকানে। কাঁধে তুলে নিয়েছেন কাপড়ের বস্তা, রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে কেটেছেন থান, আবার কখনো নিজেই সেলসম্যানদের সাথে দাঁড়িয়ে বিক্রি করেছেন কাপড়। এগুলোই তাদের সফলতার মূলমন্ত্র।

 

অসফলতার পেছনে অনেক অজুহাত থাকে। আর সেই অজুহাত শুধু নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই, এমনটাই বিশ্বাস করেন রুবাবা আকতারের স্বামী আরিফ চৌধুরী। তাই নিজের কাজের পাশাপাশি স্ত্রীর সাথে সমানতালে সামলেছেন ব্যবসা আর সন্তানকে। ব্যবসায়ী হওয়ায় বাসা ভাড়া পেতেও বিপাকে পড়েছেন, বার বার হয়েছেন অপমানিত। ব্যবসার শুরুতে এ ধরনের ছোট ছোট প্রতিবন্ধকতার সাথে সাথে সম্মুখীন হয়েছেন বড় সমস্যারও। বিমানবন্দরের ঝামেলা থেকে শুরু করে পোহাতে হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও। এরপরও রীতিমত যুদ্ধ করে করে গেছেন। আশ্রয় হয়েছেন পরস্পরের।

 

সেলাইয়ের কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন এই দম্পতি। সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন প্রতিনিয়ত। মাত্র একজন নারী কর্মীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করা সেলাইয়ে এখন কাজ করছে প্রায় অর্ধশত নারী। পাশাপাশি খাতভেদে কাজ করছেন পুরুষেরাও।

 

পিংক সিটি শপিং মলের চারতলার ছোট্ট দর্জির দোকান সেলাই থেকে আউটলেট, প্রায় ১১ বছর রুবাবা আকতার ছিলেন অনলাইন মার্কেটিংয়ের বাইরে। পরিচিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সময়ের সাথে তাল মিলিতে ২০১৯ সালের রমজান মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও নিজের উপস্থিতির জানান দিতে থাকেন রুবাবা। ফেসবুক লাইভ আর আউটলেট, সমানভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। পরিচিত হয়ে উঠেন 'সেলাই আপু' নামে।

 

সেলাই আপার শখ থেকে সাফল্য

 

২০১২ সালে বিভিন্ন কারণে পোশাক ডিজাইন করা থেকে দূরে সরে আসলেও সম্প্রতি আবারো ডিজাইন করা শুরু করেছেন রুবাবা আকতার। সেলাই থেকেই 'কালার লাইফ' নামে সাব-ব্র্যান্ড হিসেবে আলাদা একটা স্থান করে দিয়েছেন নিজের সৃষ্টিকে। শুধু তাই নয়, 'কালার লাইফ' নিয়ে গ্রাহকদের প্রচুর সাড়াও পেয়েছেন তিনি।

 

নিজেদের দীর্ঘ পথচলার এক যুগ পার করে তাই নতুনদের পরিশ্রমী আর সৎ পথে থাকার পরামর্শ দিলেন রুবাবা আকতার। অন্যকে দেখে ব্যবসা শুরু না করে, নিজের শখ আর আনন্দের কাজকেই প্রাধান্য দিতে হবে নতুনদের। সেই সাথে থাকতে হবে অপ্রতিরোধ্য চেষ্টা আর সাহস। রুবাবা আকতারের 'সেলাই' এর পাশাপাশি সদাগর ডট কম নামের একটি সফল অনলাইন মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা করেছেন আরিফ মোহাম্মদ আবদুস শাকুর চৌধুরী। তিনি বিশ্বাস করেন, সফলতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। স্বপ্ন যাই হোক, স্বপ্ন পূরণের পথে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগুনোই সফলতার মূলমন্ত্র। প্রতিবন্ধকতা আসবেই, কর্মক্ষেত্রে সফল হতে হলে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে সাহস নিয়ে।

 

 

সেলাইয়ের আউটলেটগুলো

 

গুলশান ব্রাঞ্চ
সেলাইয়ের সবচেয়ে পুরানো আউটলেট এটি। ঠিকানা- ৫ম তলা, পিংক সিটি শপিং মল, গুলশান।

 

ধানমন্ডি ব্রাঞ্চ
ঠিকানা- ২য় তলা, মেট্রো শপিং সেন্টার, ধানমন্ডি।

 

বনানী ব্রাঞ্চ
ঠিকানা- রোড ৭, বাসা ৩৫, ব্লক জি, বনানী।

 

উত্তরা ব্রাঞ্চ
ঠিকানা- রোড ১৮, বাসা ৩৯, সেক্টর ৩, উত্তরা।

 

এছাড়াও যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারেন সেলাই- এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে- https://www.facebook.com/shelaibd

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ