বিষণ্ণতা, প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত
বর্তমান কিশোর-তরুণদের একটি অংশ নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ডুবে থাকছে একাকীত্বে। ফলে আক্রান্ত হচ্ছে বিষণ্ণতা নামক মারাত্মক ব্যাধিতে। গেল বছরের ১১ নভেম্বর আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী ঐশী। মেয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নিয়ে ফেসবুকে এক হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস দেন ঐশীর বাবা আহমেদ রাশিদ জয়। স্ট্যাটাসটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয় এবং যা বিষণ্ণতা নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে নতুনভাবে।
শুধু ঐশী না। প্রায় প্রতিদিনই দেশের আনাচে-কানাচে ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর, ঈদের কেনাকাটা, এমনকি পারিবারিক অশান্তির কারণে এই প্রজন্মের অনেকেই বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। যখন তরুণদের বিশ্বজয়ের কথা, তখন কেন তারা বিষণ্ণতায় ভোগে? কী এর প্রতিকার? আমাদের এবারের আয়োজনে বিষণ্ণতার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত জেনে লিখেছেন সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার।
এখনকার প্রেক্ষাপটে ষোলো-সতেরো বছরের কিশোররা নানা সৃজনশীল কাজ করছে। বিভিন্ন উদ্ভাবনী চিন্তা ও প্রকল্প তৈরি করে সুনাম অর্জন করছে। নিত্যনতুন ভাবনায় উদ্যোক্তা হয়ে বা পড়াশোনায় সাফল্য পেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, উজ্জ্বল করছে দেশের নাম। কিন্তু অন্যদিকে এই কিশোর-তরুণদেরই একটা বড় অংশের রোগের নাম বিষণ্ণতা। তারা নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে ডুবে থাকছে একাকীত্বে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি একটি মানসিক ব্যাধি, যা মূলত দীর্ঘদিন ধরে উপযুক্ত কারণ ছাড়া মন খারাপ করে থাকা এবং কষ্ট পাওয়া থেকে জন্ম নেয়। মাত্রা বাড়লে এটা অনেকটা নেশার মত হয়ে দাঁড়ায়। বিষণ্ণতার রোগী বিষণ্ণ থাকতেই পছন্দ করে।
কৈশোর ও তারুণ্যের যে উচ্ছ্বাস এক সময় মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রেরণা ছিল, এই প্রজন্মের সেই উচ্ছ্বাসে মাতার বয়সটাই দখল করে নিয়েছে বিষণ্ণতা নামক ব্যাধি। সম্প্রতি ঐশী নামের এক স্কুলপড়ুয়া কিশোরীর আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কয়েকবছর আগে নিজের বাবা-মা’কে খুন করে খবরের শিরোনাম হয়েছিল আরেক ঐশী। দু’টি ঘটনার প্রেক্ষাপট এক নয়, ধরনও ভিন্ন, তবে দু’টি ঘটনাই হতাশা জাগায়। বিশেষজ্ঞরা এও বলেন আত্মহত্যার পেছনের কারণ বিষণ্ণতা, আবার এই বিষণ্ণতাই কাউকে করে দেয় বিশৃঙ্খল। ফলে জন্ম নেয় সহিংসতার ঘটনা, উগ্রবাদ, মাদকাসক্তি বা বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। কেন এই ব্যাধি? কেনই বা এই সমস্যায় ভুগছে তারা? একইসঙ্গে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে কিশোর- তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা। কেন ঘটছে এমনটা, কী তার প্রতিকার, এবার একটু অনুসন্ধান করা যাক।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ রয়েছে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে। তাদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হবার কারণ বিষণ্ণতা। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিষণ্ণ হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। জরিপে দেখা গেছে, দেশে আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের মধ্যে ৪১.২ ভাগ এই পথ বেছে নিতে চায় পারিবারিক সমস্যার কারণে, ১১.৮ ভাগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে, ১.৮ ভাগের বৈবাহিক সমস্যা, ১১.৮ ভাগের প্রেমে ব্যর্থতা, পরকীয়া ১১.৮ ভাগ, নির্যাতন ৫.৯ ভাগ ও আর্থিক অনটনের সমস্যা ৫.৯ ভাগের। এই জরিপ-ই প্রমাণ করে, বিষণ্ণতায় ভোগার কারণ অনেক।
মনোশিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল বলেন, আজকাল তরুণ-তরুণীদের বিষণ্ণতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারিত হওয়া এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়া। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহারও এমন ঘটনা ঘটাতে ভূমিকা রাখছে। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর পরিবারের কটুক্তির কারণে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে অনেক কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী। কেউ কেউ বিষণ্ণ হন একাকীত্বের কারণে, বা প্রত্যাশিত চাকরি না পেয়ে। স্কুলপড়ুয়া অনেক কিশোর-কিশোরীই আজকাল অতিরিক্ত চাপ সইতে পারেনা। ফলে তাদের মধ্যে একপ্রকার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, আর এতে করে তাদের অনেকেই নিজেকে ধ্বংস করার জন্য উপায় খুঁজতে থাকে। কেউ কেউ মাদককে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। তবে সময় মতো কাউন্সিলিং করলে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। সমস্যা হল, বাংলাদেশে সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত বিষণ্ণতাকে কোনো রোগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফলে যিনি বিষণ্ণতায় ভোগেন, তিনি অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েন।
বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যা করা ঐশীর বাবা সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করে লিখেছেন, তার মেয়েকে চিকিৎসকের দেয়া ওষুধের মাত্রা ঠিক ছিলনা, যা তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করেছে। এমন এন্টি-ডিপ্রেশন ড্রাগ আজকাল অনেকেই সেবন করছে। এই অভিযোগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে চিকিৎসক ভুল করেছিলেন কিনা, তারচেয়েও যে বিষয়টি বেশি ভাবিয়ে তোলে তা হল, এত অল্পবয়সী একটি মেয়েকেও কেন বিষণ্ণতার ওষুধ নিতে হয়েছে? খুব গুরুতর কোনো কারণ ছিল কী?
হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. সালমা ইয়াসমিন বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব অল্পবয়সেই এমনটা হওয়ার কারণ পারিপার্শ্বিক চাপ। স্কুলপড়ুয়া মেয়ে প্রতিদিন ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছুটছে। অবসরের ফুরসত নেই, নেই বিনোদন। পরীক্ষায় খারাপ করেছে? পাশের বাসার আন্টির কটুক্তি শুনতে হবে। বাবা-মা বকা দেবে। ফলে এইটুকু বয়সেই তারা বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করে। সবসময় সবকিছু প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না, এ বিষয়টিও তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। তারা সারাক্ষণ স্মার্টফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত থাকছে, সেখানে অন্য এক জগত তৈরি করে নেওয়ায় দূরত্ব বাড়ছে বাস্তব জগতের চারপাশের মানুষদের থেকে।
স্বাভাবিক আন্তরিকতা হলে যেকোনো মতকে গ্রহণ করার যে সক্ষমতা তৈরি হয় বা মানসিক বিকাশ হয়, তা তাদের অনেকের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এমনকি, ফেসবুকের পোস্টে, সেলফিতে কতগুলো লাইক এলো, কে কী কমেন্ট করল, তা নিয়েও তারা অস্থিরতায় ভুগতে থাকে। কারোর দ্বিমত মানতে পারেনা। নিজেকে একটা গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলার ফলে আশপাশে নিজের সমস্যা খুলে বলা যায় এমন কেউ থাকে না। এরকম অবস্থায় অন্যের হাসিমুখ দেখেও তারা দুঃখ অনুভব করে, বিষণ্ণ বোধ করে। আবার অনেকেই আছে যারা ছোটবেলা থেকে অন্তর্মুখী বা ইন্ট্রোভার্ট, সহজে কারোর সাথে মিশতে পারেনা। দেখা গেল স্কুলে বন্ধুরা খেলায় নিচ্ছে না, আড্ডায় যোগ দিতে পারছেনা, এই বিষয়টিও একসময় তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। এদের জন্য বাড়তি যত্ন প্রয়োজন হয়।
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মোনাওয়ার আলী বলেন, মূলত বিষণ্ণতা বলতেই বোঝায় মন খারাপ হবার একটা মানসিক অবস্থা। কিন্তু এই বিষণ্ণতা হতে পারে বিভিন্ন ধরণের এবং প্রতিটি মানুষ ভিন্ন ধরনের বিষণ্ণতায় ভুগে থাকেন। সকলের বিষণ্ণতার ধরন একই রকম হয় না। বিষণ্ণতা দূর করার জন্য পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের সহযোগিতাও একান্ত প্রয়োজন। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মানসিক ইতিহাস জেনে কয়েকটি ধাপে চিকিৎসা দেন। কাউন্সিলিং এবং কথা বলার মাধ্যমে উজ্জীবিত করা হল প্রথম ধাপ। বিষণ্ণতার মাত্রা বেশি হলে সেটা যথাযথভাবে নিরূপণ করে ওষুধ সেবন করতে বলা হয়। যেহেতু ওষুধ মাত্রই সেটির উপকারের পাশাপাশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে, তাই বিশেষজ্ঞের মতামত ছাড়া কোনোভাবেই নিজে হুট করে ওষুধ সেবন করা যাবেনা। ছোট ভুলে মারাত্মক পরিণতি হয়। কিছু ওষুধ ভুলমাত্রায় সেবন করলে আসক্তি তৈরি করে, কোনোটি আত্মহত্যা-প্রবণতা তৈরি করে। নির্দিষ্ট মাত্রা জেনে বুঝে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতই ওষুধ খেতে হবে। এছাড়া অনেকসময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণেও বিষণ্ণতা হয়, সেক্ষেত্রে রোগকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা নিতে হবে। মস্তিষ্কের নানা রাসায়নিক পদার্থ, হরমোনের সঙ্গে অনুভূতির যোগসাজশ রয়েছে। এমনকি খাদ্যাভ্যাসও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি বিষয়ে পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মডেল মিস আয়ারল্যান্ড খেতাবপ্রাপ্ত মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি বলেন, তরুণ প্রজন্মের সঠিক বিনোদনের খুব অভাব। আর দিনরাত অযাচিত পড়ার চাপ, যেকোনো কাজে ব্যর্থ হলেই অন্যের কটূক্তি, সামাজিক যোয়াযোগমাধ্যমে নিজেকে শো-অফ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, এমন নানাবিধ কারণ বিষণ্ণতা তৈরি করছে। ধীরে ধীরে সেই বিষণ্ণতাই ডালপালা বিস্তৃত করে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জুবায়ের আহম্মেদ বললেন, সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। এতে যারা নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা বিষণ্ণতায় ভোগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইকোলজিস্ট ও বিনামূল্যে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন যেকোনো মানসিক সমস্যা মোকাবেলায় শিক্ষার্থীরা সহায়তা নিতে পারে।
প্রায় একই কথা বললেন সদ্য সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া চিকিৎসক ডা. ইসরাত জাহান। তিনি বললেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং ইউনিট রাখার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদেরকে উৎসাহ দিতে হবে, যেন তারা পরিবারের বড়দের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কে গড়ে তোলে, যেকোনো কথা শেয়ার করতে পারে। পরিবারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকলে হতাশা তৈরি হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হুমায়রা আঞ্জুমী নাবিলা বলেন, আমাদের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা যে মানসিক সক্ষমতা ও প্রশান্তির উপর নির্ভরশীল, সেটা খুব কমি ভেবে দেখা হয়। হাজার কাজের ব্যস্ততায় নিজের মনের যত্ন এবং শতভাগ মানসিক সুস্থতা খুব বেশি প্রয়োজন, এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়ার ধারণা, প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষিত তরুণতরুণী লেখাপড়া শেষ করছে, সে তুলনায় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছেনা। এটিও একটা বড় অংশের বিষণ্ণতার কারণ।
হতাশাকেন্দ্রিক আরেক ভয়াবহ সমস্যা হল মাদক। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের পঞ্চাশভাগ তরুণ নানারকম নেশায় আসক্ত। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ধ্যা নামার পর পরই অলিগলিগুলোর নির্দিষ্ট জায়গায় মাদক বিক্রি শুরু হয়। এ মাদকদ্রব্য ক্রেতাদের বেশিরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যারা এসব ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে। পর্যায়ক্রমে ওই শিক্ষার্থীরা বন্ধুবান্ধবদেরও মাদক নিতে প্ররোচিত করে, এভাবে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নেটওয়ার্ক। শুধু তাই নয়, স্কুলের শিক্ষার্থীরাও এই ক্রেতার তালিকায় রয়েছে। মাদক নিচ্ছে মেয়েরাও। মাদকাসক্তি বিবেকবোধকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে, আসক্ত ব্যক্তি কারোর প্রতি সহিংস হয়ে উঠতেও দ্বিধা করে না। যেমনটা ঘটেছিল বাবা-মা’কে খুন করা ঐশীর ক্ষেত্রে। এছাড়া মাদকাসক্তরা মাদকের অর্থের জোগান দিতে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়াচ্ছে। মাদক কেনার টাকার জন্য সন্তানের কাছে বাবা-মা জিম্মি হচ্ছেন। পরিবারে বিরোধ বাড়ছে, সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমস্যা আরও বড় আকার ধারণ করছে।
আগের প্রজন্মের প্রায় সবার ছোটবেলা কেটেছে দারুণ পারিবারিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে। তখন ‘একান্নবর্তী পরিবার’শব্দটারও খুব চল ছিল। বাবা-মা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু—সবাই মিলে একসঙ্গে থাকা হতো একই বাড়িতে। বিকেল হলেই চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন ও পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে গল্প করা, মাঠে খেলতে যাওয়া, ছোটাছুটি, কানামাছি থেকে শুরু করে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে সময় কাটত সবার। ঝড়ের পরে গাছের নিচে আম কুড়াতে যাওয়া, বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই এখনো মনে দোলা দেয়। ছোটদের এই দলের কেউ পরীক্ষায় খারাপ করেছিল, মা বকছিলেন? হুট করে কেউ একজন রক্ষকের ভূমিকায় এসে যেতেন, ‘থাক না, ছোট মানুষ তো, পরেরবার ভালো করবে।’
সেই সময়টা পুরোপুরি বদলে গেছে। একদম স্কুলপড়ুয়া ছোটদেরও সারাক্ষণ সময় কাটানোর উপকরণ এখন স্মার্টফোনের গেম, ট্যাব ইত্যাদি। আর অল্প একটু বড় হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো যোগ হচ্ছেই। নেই মাঠে খেলতে যাওয়া বা সবাই মিলে গল্প করার অভ্যাস। শহরে খেলার মাঠ নেই, এই অজুহাতে সন্তানের হাতে বাবা-মায়েরা খুব অল্প বয়সে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছেন, আর তা নিয়ে সারাক্ষণ মত্ত থেকে সন্তান অন্যের সঙ্গে মিশছে কি না, তার সামাজিকীকরণ হচ্ছে কি না—শহুরে জীবনের ব্যস্ততায় সেই খবর নিতে ভুলে যাচ্ছেন বাবা-মাও। আর ব্যাগ ভর্তি বোঝার মতো বই নিয়ে পড়ার চাপ, কোচিং ক্লাস, প্রাইভেট টিউটরের কাছে ছোটাছুটি তো আছেই। ফলে বেড়ে ওঠার বয়সে হারিয়ে যাচ্ছে নির্মল বিনোদনের আনন্দ, সারাক্ষণ একা বসে থেকে সন্তানও হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। খেলাধুলা করলে হার-জিতের মাধ্যমে যেকোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়, এই শিক্ষাটাও জুটছে না তাদের ভাগ্যে। এই সন্তান যখন বড় হচ্ছে, তখন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লেই তার সঙ্গী হচ্ছে বিষণ্ণতা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারহানা জামান বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো মানসিক রোগ বা রোগীর চিকিৎসার বিষয়টি সেভাবে প্রচলিত হয়নি। বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যে কেউই ‘স্ট্রেসড’ হতে পারেন, মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন। সেক্ষেত্রে অন্যদের দায়িত্ব হলো তা থেকে তাকে মুক্ত হওয়ার উপায় দেখানো। আমরা তা করি না, বরং ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার প্রবণতা আছে আমাদের মধ্যে। এতে করে সমস্যায় ভোগা ব্যক্তি আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। কাউকে বিষণ্ণ দেখলে বা কারোর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করলে এই পরিস্থিতির উত্তরণে পরিবারে, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ভূমিকা রাখতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর তাসনুভা হক বলেন, বৈশ্বিকভাবেই মানুষের বিষণ্ণতা বাড়ছে। তাছাড়া তারুণ্যের সময়টাতে বয়সকালীন বিভিন্ন আবেগীয়, সামাজিক পরিবর্তন, যেমন- বন্ধুত্ব, ভালোবাসার সম্পর্ক, শিক্ষাজীবনে পরিবর্তন স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। এছাড়াও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি বা আত্ম-ধারণা খুব অস্পষ্ট এবং নেতিবাচক হলে সহজেই অন্যের মন্তব্য বা বিভিন্ন ঘটনা থেকে ব্যক্তি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আর এই আত্ম -ধারনা শিশুকালের নানা অভিজ্ঞতা, প্যারেন্টিং ধরনের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কোন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা যেমন, আবেগীয় বা যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বর্তমান জীবনকে প্রচণ্ডভাবে ব্যহত করে। এছাড়াও বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক ধরণটি কেমন তা গুরুত্বপুর্ণ। অনেক সময়ই টেকনোলজি ব্যবহারের দক্ষতায় বাবা-মারা পিছিয়ে পড়েন যা সন্তানদের সাথে সম্পর্কে ভালো রাখতে বাধা তৈরি করে। প্রত্যাশা – প্রাপ্তির অমিল, পিয়ার প্রেশারও দীর্ঘকালীন মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। এ ধরনের মানসিক অবস্থাগুলোতে ব্যক্তি মনোবল হারিয়ে ফেলে, নিজের ইতিবাচক দিকগুলো আর দেখতে পায় না। নানা কষ্টের অভিজ্ঞতা মনের উপর প্রচণ্ড ভার তৈরি করে। তাই বলা যায় কোন একক কারণ নয় বরং জীবন চলার পথের নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই বিষণ্ণতা কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কিছু তরুণ বোঝেন না, জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত আসতেই পারে। সেসবকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মোকাবিলা করাই জীবন। অথচ তারা বিষণ্ণতায় ভোগার কারণে নষ্ট হয়ে যায় অনেক মূল্যবান সময়। জীবন মূল্যবান, আনন্দময়। জীবন যদি আনন্দময় না হতো তাহলে কি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এত কিছু করত? আর জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থাকলেও প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। আর এজন্যই প্রতিটি মানুষের কাছে জীবন আনন্দময়। দৈনন্দিনের একঘেয়েমিকে পাশ কাটিয়ে একটু ভিন্নভাবে জীবনযাপনে নতুনত্বের স্বাদ মেলে। প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করা, নতুন সাজে উপস্থাপন করাই তারুণ্যের ধর্ম।
বিষণ্ণতায় ভুগলে সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ও কাউন্সিলিং করানোর ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে ভাবতে হবে, যেকোনো সমস্যা থেকেই বেরিয়ে আসা সম্ভব। পরীক্ষায় ফল ভালো হয়নি? আবার মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করুন। আপনি নিশ্চয়ই ভালো করবেন। চাকরি খুঁজতে গিয়ে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে দমে না গিয়ে বিশ্বের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন—এরকম বহু উদাহরণও তো জানা। তাই কখনোই আশাহত হওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিভাবক ও চারপাশের মানুষদেরও দায়িত্ব হলো, কাউকে বিষণ্ণ হতে দেখলে তার পাশে থেকে তাকে অনুপ্রেরণা জোগানো। যে প্রজন্ম ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে, সেই প্রজন্ম বিষণ্ণতায় ভুগলে চলবে কেমন করে? তাই এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরতে হবে। ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে আনন্দের সময় কাটাতে হবে। এভাবেই সম্ভব নিজেকে উজ্জীবিত রেখে সুন্দরের ও ইতিবাচকতার পথে এগিয়ে যাওয়া।