Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এবার তালা ভাঙার পালা

সভ্যতার শুরু থেকে আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীকে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছে, মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছে, কিংবা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে। আর এই বন্দি করবার ফন্দি হিসেবে নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিল গৃহকর্মের বোঝা,  যে বোঝা একবিংশ শতকেও আমরা নামাতে পারিনি। পুঁজিবাদ যদিওবা নারীকে অর্থনীতিতে যুক্ত করল, তবু এ বোঝা লাঘব হলো না। বরং নারীর ওপর ডাবল বার্ডেন দেওয়া হলো। ক্যারিয়ার বা চাকরি নারীর জন্য অপশনাল আর সংসার ম্যান্ডেটরি। সন্তান সংসারের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে হবে তাকেই; কেননা এটাই তার মৌলিক চাহিদার মতো মৌলিক বা বেসিক দায়িত্ব। অথচ রি-প্রোডাক্টিভ কাজের মধ্যে সন্তান গর্ভধারণ, জন্মদান, স্তন্যপান ব্যতীত বাদবাকি কোনো কাজই প্রাকৃতিকভাবে নারীর ওপর বর্তায় না। 

৮ মার্চ বিশ্বের সকল দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘ বছর ধরে। নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করত, এখন এনজিও থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই নারী দিবসের কর্মসূচিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেও স্পন্সর করছে। এবং নারী দিবসের মাহাত্ম্য তুলে ধরছে। এ-যে শ্রেফ ব্যবসা তা আমাদের দেশের অনেক নারী সংগঠনই বুঝে না বা বুঝতে চায় না।
আজো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, জাতিতে, সমাজে বিভিন্ন পৈচাশিক নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে নারী পথ চলছে। প্রতি মুহূর্তে নির্যাতনের আশঙ্কা নিয়ে জীবন পাড়ি দিতে হচ্ছে নারীকে। সেই নারীদেরকে নিয়েই নারীদিবস।

নারীর যথা যোগ্য সম্মান, অধিকার আর সুবিচারের দাবি নিয়ে নারীমুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল শতাধিক বছর আগে, আজো সেই সংগ্রাম শেষ হয়নি। নারীকে আজো লড়াই করতে হচ্ছে তাদের মৌলিক চাহিদা আদায়ের লক্ষ্যে।
নারী মানুষ, এই ধারণাটাই অনেক সমাজে, রাষ্ট্রে বা জাতিতে বুঝতে চায় না বা মানতে চায় না। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বের অনেক ধনী দেশেও নারী দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। ভোটাধিকার তো অনেক পরের ব্যাপার। তাদের একা চলাফেরা করারও অনুমতি নেই অনেক দেশে। সে দেশগুলো অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকলেও নারী স্বাধীনতায় অনেক পিছিয়ে। ধর্মের দোহাই দিয়ে আজো বন্দি জীবনযাপন। 

নারীর বাইরের কাজ বা অর্থনীতিতে সম্পৃক্ততাকে অপশনাল হিসেবে দেখবার বড়ো কারণ কয়েকটি গুরুতর ভাবনা- নারীর দায়িত্ব পুরুষের/নারী পুরুষের অধঃস্তন/নারীকে পুরুষের জন্য তৈরি করা হয়েছে/ নারীর ভরণপোষণ পুরুষের দায়িত্ব/নারী পুরুষের সেবা করবার নিমিত্তে সৃষ্টি ইত্যাদি। এসব কথা কোনো নারী তার একজীবনে একবারও শোনেননি এটা অকল্পনীয়, আর প্রতিনিয়ত শোনেন এরকম নারীদের হাত তুলতে বললে অনুপাত হতে পারে দশে-নয়। 
নারী মানুষ, মেয়েমানুষ নয়, পুরুষের বাম পাঁজরের হাড্ডি থেকে সৃষ্ট কোনো আংশিক মানুষ নয়, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই আজো বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে নারীকে। মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের স্বপ্নে বিভোর, সেই সময় এখনো এমন অলীক ব্যাখ্যার মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। শুধুমাত্র আমাদের দেশের অশিক্ষিত পুরুষ নয়, শিক্ষিত সমাজের বেশিরভাগে পুরুষেরা এই চিন্তা পোষণ করে থাকেন। শুধু পুরুষই নয় অনেক নারীও এই চিন্তাকে সমর্থন করে পুরুষের আধিপত্যকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে চলেছেন।
নারী দিবসের এই ক্ষণে অনেকেই বলে থাকেন বিশেষ একদিন নারী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে নারীকে আরো দুর্বল, অসহায় বা নিম্ন শ্রেণিতে প্রকাশ করা হচ্ছে। বাস্তবতা ভিন্ন। নারী যতদিন অধিকার আদায় করতে না পারছে, যতদিন নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি না পাচ্ছে, যতদিন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব থেকে মুক্ত না হচ্ছে, ততদিন এই নারীদিবস অবশ্যই পালনীয়, অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। একদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া সমাজের একটি অংশ তার সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সে শুধুমাত্র লিঙ্গভেদে অবহেলিত, নির্যাতিত হচ্ছে। তাকে কিছু একক কাল্পনিক বেড়া জাল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। 
নারীরা এখন শুধু রেঁধে কিংবা চুল বেঁধেই তাদের দিন অতিবাহিত করেন না। এখন তারা সবখানেই নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন নিজ নিজ যোগ্যতা, মেধা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আমাদের দেশের নারীদের সরব অবস্থান এখন কেবল পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই, সমাজের বিভিন্ন স্তর-প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার, ভিডিপি, বিজিবি, বিমান পরিচালনা, ট্রেন পরিচালনা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, শিক্ষকতা, নার্সিং, রাজনীতি, সর্বত্র নারীর বিচরণ রয়েছে। শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত- সব স্তরের নারীই কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতিতে নিরবচ্ছিন্ন অবদান রাখছেন। সরকারি সংস্থা বিডিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, জিডিপিতে কর্মজীবী নারীদের অবদান ২০শতাংশ। শুধু তাই নয়, অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১কোটি ৬৮ লাখ নারী অর্থনীতির সূচকের তিন খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করছেন। অর্থনীতিতে নারীর সাফল্য বেড়েছে, নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে উৎপাদন ব্যবস্থায়।
আর এভাবেই সকল বাধার দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে নারী, সকল ক্ষেত্রে রাখছে দক্ষতা ও মেধার স্বাক্ষর। সুতংরা ‘অবলা’ তত্ত্ব দিয়ে নারীকে অবমাননার চিন্তা ভুলে যান, নারীরাই তাদের শক্তি, মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে এই অবলা তত্ত্বকে ‘নাই’ করে দিবে শিগগিরই! এবং পুরুষের কর্তৃত্বের তালা ভেঙে নারী উদ্ভাসিত হবে আপন আলোয়।

ছবি : তানভীর আহমেদ

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ