দিনের শেষে
ধানমন্ডি দুই থেকে শ্যামলী যাব। মাসের শুরু। মাত্র বেতন পেয়েছি। পকেট গরম। সুতরাং একটা উবারই ডেকে নিলাম।
যাচ্ছি আমার এক বন্ধুর বিয়ে বার্ষিকীতে।
ভার্সিটি থেকে বেরুবার পর আমরা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নিজ নিজ গন্তব্যের দৌড়ে কেউ অনেকদূর চলে গেছে আর কেউ দৌড় শুরুই করতে পারেনি। স্টার্টিং পয়েন্টই খুঁজে পাচ্ছে না।
আমি অবশ্য দৌড় শুরু করেছি। তবে দুই পা একরশিতে বেঁধে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যেন, যা দৌড়া!
আর আমিও উস্টা খেতে খেতে টুকুন টুকুন করে এগোচ্ছি। তবে এতে আমার কোনো আফসোস নেই। কোনোমতে পথটা পাড়ি দেওয়াই তো কথা!
উবারের ভেতর সুশীতল সুরভিত পরিবেশ।ড্রাইভার সম্ভবত কোনো এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করেছে। বসে মনে মনে ভাবলাম, নিজের এমন একটা গাড়ি থাকত যদি!
রাস্তায় যত যানজট আর ভিড়-ভাড়াক্কা থাকুক, সূয্যি যত কঠিন উত্তাপই ছড়াক না কেন, জানালা-দরজা বন্ধ গাড়ির ভেতর তার কোনো স্পর্শ নেই। সব সুস্নিগ্ধ, সুমিষ্ট! একদম গোছানো। বাইরের কুৎসিত কোলাহল মিথ্যে মনে হয়।
২.
ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। বাস্তবে দেখছি, লেখাপড়া না-করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। আমার সহপাঠী এবং বন্ধুদের মধ্যে যারা বরাবর ভালো ফলাফল করে পড়াশোনা শেষ করেছে, তারা কেউই এখনো ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু যারা টেনে মেনে পড়া শেষ করেছে তারা চাকরির আশা না-করে ব্যবসা-ট্যাবসা শুরু করেছিল, কেউ কেউ দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল এবং তাদের প্রায় সবার এখন গাড়ি আছে। বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে। জমি আছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে। অবশ্য বন্ধুদের প্রায় সবাই বিবাহিত এবং সন্তানের জনক। কেবলমাত্র আমারই বিয়ে করার ভাগ্য হয়নি এখনো। বীমা কোম্পানির চাকরি করি। বেতন যা পাই নিজে খেয়েপরে মেস ভাড়া দিয়ে বাড়িতে পাঠানোর পর মাসে হাতখরচ বাবদ যা থাকে, তা দিয়ে বউ রাখা সম্ভব না। আজকাল বউরা শুধু ভাত আর ভালোবাসায় মজে না। প্রতি মাসে নানাসামাজিক উৎসব, এই দিবস ওই দিবস আরো কত কীতে বৌদের চাই নতুন শাড়ি, জামা-জুতো-গয়না। চাই সপ্তাহান্তে বেড়ানো আর ভালো ভালো দোকানে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করা। এবং নতুন নতুন সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে তামাম পৃথিবীকে মানে বান্ধবীমহলকে জানানো, আমি সুখী!
আমার সে সামর্থ্য আজো হয়নি। তাই বিছানাও ডাবল হয়নি।
অথচ আমার একটা বউ থাকতেই পারত।
ফারিয়াকে আজো আমি ভুলতে পারি না। আজো আমার নিঃসঙ্গ একাকী ক্ষণে ফারিয়া আমার বুকে কষ্টের ধোঁয়া হয়ে জ্বালা করে আমার চোখের কোণটুকুতে জলের ফোঁটা জমিয়ে তোলে।
৩.
আমাদের মাহিপুর গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ির মেয়েদের সৌন্দর্যের নামডাক আছে। লোকমুখে শোনা যায়, ভূঁইয়া বাড়ির পূর্বপুরুষের কেউ একজনকে পরী বিয়ে করেছিল। তাই তাদের পরিবারের মেয়েরা এমন সুন্দরী।
আমি অবশ্য পরীটরীর গল্প বিশ্বাস করি না। তবে এটা স্বীকার করি ভূঁইয়া বাড়ির মেয়েগুলো আসলেই এক একজন অস্পরী। ¯্রষ্টা নিজ হাতে নিখুঁত করে গড়েছেন তাদের। সেই বাড়ির মেয়ে ফারিয়ার সাথে কলেজে পড়তে কীভাবে যেন আমার ভীষণ ভাব হয়ে গেল। আমি ভীরু, বোকা একজন মানুষ। ফারিয়াই আমার সাথে ভাব জমালো। ওর কোনো কাজ লাগলে বা কোথাও যেতে লাগলে আমাকে মোবাইলে টেক্সট করত। ওর টেক্সটের ছোট ছোট অক্ষরগুলোয় আমি ওর ঝরনার কলতানের মতো মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ শুনতে পেতাম। একছুটে গিয়ে কলেজ রোডের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। ফারিয়াকে যখন দেখতে পেতাম স্পষ্ট টের পেতাম আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দের গতি বেড়ে গেছে!
কলেজে যাবার নাম করে ফারিয়া আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে শহরে চলে যেত। ও সিনেমা দেখতে পছন্দ করত। শহরের ময়ূরী হলে দুজনে পাশাপাশি বসে সকাল দশটা পঞ্চাশের শো-তে কত ছবি যে দেখেছি! ছবি দেখার সময় ফারিয়া আমার হাতটা ওর দুহাত দিয়ে ধরে রাখত। আমার মধ্যে তখন তীব্র ভালো লাগার পাশাপাশি তীব্র ভয়ও কাজ করত। ভয় হতো যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে খারাপ বলবে। আর ভালো লাগত ফারিয়ার কোমল হাতের স্পর্শ।
সে স্পর্শে আমার আঙুলে একমিষ্টি সুবাস রেখে যেত। যেদিন ও আমার হাত ধরত সেদিন ও চলে যাবার পর আমি বারবার আমার হাতের তালু শুখতাম, আঙুল শুখতাম। দীর্ঘসময় হাত ধুতাম না, যদি ওর গন্ধটা ধুয়ে যায়!
হ্যাঁ, আমরা প্রেমে পড়েছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ফারিয়া স্থানীয় কলেজেই ডিগ্রি ভর্তি হলো। আমি বলতে গেলে ফারিয়াকে ছেড়ে আসতে হবে বলে তীব্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফারিয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।
কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।
আমি পাস করে বেরুবার আগেই ফারিয়ার বিয়ে হয়ে গেল আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী, বন্ধু এবং আমাদের পাশের গাঁয়ের চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে মারুফের সাথে।
মারুফ পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না। পড়ার পাশাপাশি সে টুকটাক বেশ কয়েকটা বিজনেস শুরু করেছিল। বাবার টাকা তার সাপোর্ট ছিল।
মারুফের সাথে বিয়েতে ফারিয়া সানন্দেই সায় দিয়েছিল। বিয়ের খবরে আমি কী পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলাম, সেটা প্রকাশ করিনি। ফারিয়াকে ফোন করে করে ক্লান্ত হয়েছি। ও ফোন রিসিভ করেনি। ব্লক করে দিয়েছিল। তারপর একদিন একনির্জন বিষণœ সন্ধ্যায় ফোন করে বলেছিল প্রেমকরা আর সংসারকরা এক নয়। ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ভূঁইয়া বাড়ির মেয়েদের স্বামীরা সবাই ধনী। বউদের পায়ে তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে। ভালোবাসার খেসারত দিতে আমার মতো চালচুলোহীন একজনের কথা ও বাড়িতে কীভাবে বলবে?
আর বললেইবা কে শুনবে ওর কথা।
কাজেই পরস্পরকে ভুলে যাওয়াই এখন আমাদের জন্য মঙ্গল।
৪.
মারুফ আর ফারিয়ার আজ পঞ্চম বিয়ে বার্ষিকী। ফারিয়াকে বিয়ে করার পর মারুফের সাথে সমস্ত যোগাযোগ আমি নিজ থেকেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মারুফের কথা মনে হলেই আমার ইচ্ছে করত গলায় একটা টিপ দিয়ে ওর নিশ্বাস চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেই। ফারিয়া টাকার বিছানায় গড়াগড়ি করে কাঁদুক!
মাসখানেক আগে এক ব্যাংকে বীমার কাজে গিয়ে দেখি ওখানে মারুফ বসে আছে। আমি না দেখার ভান করে চলে আসছিলাম। কিন্তু মারুফ ঠিকই আমাকে ডেকে বসাল।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বললাম। কথায় কথায় জানলাম মারুফের ক্রমবর্ধমান ব্যবসার কথা। মারুফ এলসির ব্যাপারে এসেছিল।
আমি যে সামান্য বীমাকর্মী একথাটা জানাতে বাঁধছিল মনে। ফারিয়াকে আমার এই ‘দিন আনি দিন খাই’ টাইপ জীবনের কথা জানাতে চাই না। মারুফের সাথে ওর বিয়ের পর আমি বুঝেছিলাম ভীতু এবং বোকা ভেবে ফারিয়া আসলে আমাকে বডিগার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে। নির্দোষ প্রেমাভিনয়।
মারুফ তাদের বিয়ে বার্ষিকীর দাওয়াতে যেতে খুব জোর করল। আমার আর ফারিয়ার ব্যাপারটা সে হয়ত জানে না।
৫.
শ্যামলীতে মারুফের বাড়ির গেট দেখা যাওয়ামাত্র আমি উবারের ড্রাইভারের হাতে একটা হাজার টাকার নোট দিয়ে বললাম, সামনের ঐ নীল গেটটার সামনে থামুন। আর ভাড়া দেখতে হবে না। আপনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যান।
গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামছি। দেখি ফারিয়া আর মারুফ ও গেটের সামনে। আমাকে দেখে এগিয়ে এল। কোনো এক বিশেষ অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে ওরা গেটে দাঁড়িয়ে। ফারিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে পরী নেমে এসেছে। কিন্তু আমার গা জ্বলছে।
আমার ভীষণ ইচ্ছে ফারিয়া হা-হুতাশ করুক আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে! অনেক দামি একটা উপহার এনেছি আমি। উবারে চড়ে এসেছি। আমি চাই ফারিয়া জানুক আমিও ওর স্বামীর চেয়ে কম নই।
গাড়ি থেকে নামতেই মারুফ হাত মেলাতে মেলাতে বলল, দোস্ত তুই আসছোস বহুত খুশি হইসি।
আমি ফারিয়ার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে বললাম, ড্রাইভারকে চলে যেতে বলি, কী বলিস?
ক্যান ভাড়া দেস নাই?
নিজের গাড়িকে ভাড়া দিব? মুখ বাঁকিয়ে হেসে বললাম আমি।
স্যার আজ আর রোডে নামব না। গাড়ি গ্যারেজে রেখে দিচ্ছি- পেছন থেকে উবার ড্রাইভারের কণ্ঠ ভেসে এল।
মারুফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই ছাত্রজীবন থেইকাই নানান ব্যবসায় লগ্নিকরা আমার শখ, জানোস তো? উবারে আমার ছয়টা গাড়ি আছে!