নারীস্থান
ধারাবাহিক উপন্যাস
নারীস্থান
শার্লট পারকিন্স গিলমান
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
[মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উনবিংশ শতাব্দীর নারীবাদী লেখক ও সমাজ সংস্কারক শার্লট পারকিন্স গিলমান-এর নন্দিত উপন্যাস ‘হারল্যান্ড’ বাংলায় ‘নারীস্থান’ নামে ধারাবাহিকভাবে ছাপানো হচ্ছে। এ-সংখ্যায় ছাপা হলো পঞ্চম পর্ব।]
চতুর্থ পর্বের পর
অধ্যায়-৩
একটি অদ্ভুত কারাবাস
আমি প্রথমে তন্দ্রাবস্থা থেকে মৃত্যুর মতো গভীর ঘুমে চলে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে জেগে উঠলাম। শিশুর মতো সতেজ, প্রাণবন্ত লাগল নিজেকে। জেগে ওঠার সময় মনে হলো যেন গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠছি উঠছি উঠছি। ধীরে ধীরে আলোর মধ্যে, বাতাসের মন্থনের মধ্যে প্রবেশ করছি। সোজা করে বললে মস্তিষ্কে একটা আলোড়নের মধ্য দিয়ে চেতনায় ফিরে আসছি। একবার আমি সম্পূর্ণ অচেনা একটি জায়গায় বন্য পাহাড়ে ওঠার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিষ্কার মনে আছে চেতনায় ফিরে আসার সময় কেমন লেগেছিল! মনে হয়েছিল যেন একটি স্বপ্ন থেকে আস্তে আস্তে একটি পর্দা সরে যাচ্ছে। দূর থেকে ক্ষীণকণ্ঠ ভেসে আসছিল আমার কানে। কণ্ঠ কানে আসতেই আমার চোখের সামনে থেকে মনে হচ্ছিল বরফাচ্ছাদিত পাহাড় দ্রুত সরে যাচ্ছে। একপর্যায়ে পুরো চেতন হয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি।
এবারের জেগে উঠাও প্রায় একই রকম। চোখের সামনে থেকে একে একে অপসৃত হচ্ছে দৃশ্য। বাড়ি, স্টিমার, নৌকায় ওঠা, ছোট্ট প্লেনে ওঠা, বনের ভেতর সব দৃশ্য একে একে চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে অবশেষে চোখ খুললাম। মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাস্তবে এলাম। মনে পড়ল কী ঘটেছিল।
শারীরিক আরামটা আমার কাছে বড়ো করে ধরা দিল। দেখলাম আমি একটা চমৎকার বিছানায় শুয়ে আছি। যথেষ্ট বড়ো, মোলায়েম মসৃণ আরামদায়ক একটি বিছানা। বেশ আরামের হালকা তোষক, চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সুন্দর বিছানার চাদর। সবকিছুর মাঝে নিজেকে একটা হালকা পরিচ্ছন্ন পালকের মতো মনে হলো। বেশ একটু সময় লাগল নিজের হাত পায়ের অনুভূতি বুঝতে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত জীবনের সজীবতা বুঝতে।
আমি আছি বেশ বড়ো, উঁচু এবং প্রশস্ত রুমে। প্রশস্ত জানালা। বন্ধ জানালায় সবুজ হালকা আলোর আভা। সাইজ, রং, মসৃণতা সবকিছু মিলে একটি অদ্ভুত সুন্দর রুম। বাইরের বাগানের মনোরম হালকা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।
আমি সুখের সঙ্গে নিথর শুয়ে আছি। সম্পূর্ণ জেগে আছি। সম্বিত ফিরে পেলাম টেরির কণ্ঠ শুনতে পেয়ে।
‘ইশ্বর!’
মনে হয় তাই বলল।
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম তিনটি বেড পাতা আছে রুমটায়। যথেষ্ট বড়ো রুম। প্রত্যেকের অনেক জায়গা নিয়ে বিছানা পাতা।
টেরি উঠে বসেছে। ভালো মতো দেখছে। স্বভাবসুলভ সতর্ক ভাব। তার উচ্চারণটি খুব জোরে ছিল না। জেফও জেগে গেছে। আমরা তিনজনই উঠে বসলাম।
টেরি পা ঘুরিয়ে বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল। জোরেসোরে আড়মোড়া ভাঙল। তার পরনে একটি নাইটগাউন। সেলাইবিহীন কাপড়। নিঃসন্দেহে আরামদায়ক। দেখলাম আমরা তিনজনই একই রকম নাইটগাউনে জড়ানো। প্রত্যেকের বিছানার পাশে একজোড়া করে জুতা। সেগুলো পরে আমরা বুঝলাম কত আরামদায়ক! দেখতেও ভারি সুন্দর। অবশ্যই আমাদের জুতার মতো না।
আমরা আমাদের পরনের পোশাকগুলোর জন্য এদক ওদিক তাকালাম। সেগুলো কোথাও নেই। আমাদের পকেটের জিনিসগুলোও দেখলাম না।
দেখলাম একটি দরোজা কিছুটা খোলা। ওটি একটি বাথুরমের দরোজা। দেখা গেল ভেতরে চমৎকার সাজানো। তোয়ালে, সাবার, আয়না সব আছে পর্যাপ্ত সংখ্যায়। সব ধরনের সুবিধা করে রাখা। টুথব্রাশ, চিরুনি। দেখলাম আমাদের নোটবুক, আর হাতঘড়িও রাখা আছে। কেবল আমাদের পোশাকগুলো নেই।
আমরা এবার অন্য একটি রুম দেখতে পেলাম। সেখানে বড়ো আলমিরা। তাতে যথেষ্ট কাপড়চোপড় আছে, কিন্তু আমাদের নিজেদের কাপড়গুলো কোথায়!
‘আমাদের একটা সংঘাত নিয়ে আলোচনা করা দরকার,’ টেরি বলল। ‘এসো, আমরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এ নিয়ে আলোচনা করি। বিছানাটা অন্তত নিরাপদ আছে। শোনো, বিজ্ঞানসম্মত বন্ধুরা, আমাদের এই বিষয়টি দেখতে হবে নিরাবেগের সঙ্গে।’
টেরি আসলে আমার দিকেই ইঙ্গিত করল। কিন্তু জেফ আমার চেয়েও বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে ছিল। সে বলল, ‘ওরা অন্তত আমাদের গায়ে হাত দেয়নি, আহত করেনি। ওরা ইচ্ছা করলে আমাদের হত্যা করতে পারত। অথবা অন্য যে-কোনো ক্ষতি করতে পারত। তা করেনি। জীবনে আমার কখনোই এত ভালো লাগেনি।’
আমি বললাম, ‘তার মানে হলো ওরা সবাই নারী। এবং অত্যন্ত সভ্য। দেখ, তুমি শেষ মুহূর্তে হুড়াহুড়ির মধ্যে একটা মেয়েকে লাথি মেরেছিলে। সে আহত হয়ে শব্দ করে উঠেছে। এমনটা আর কোরো না।’
টেরি আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছিল। বলল, ‘তোমরা কি বুঝতে পেরেছ এই মেয়েরা আমাদের কী করেছে? ওরা আমাদের সব জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছে, আমাদের কাপড়চোপড়সহ সরিয়ে নিয়েছে। একেবারে সব। তোমাদের এই তথাকথিত সুসভ্য নারীরা আমাদেরকে একেবারে শিশুর মতো ন্যাংটা করে, গোসল করিয়ে তারপর বিছানায় ঘুম পারিয়ে রেখেছে!’
জেফ লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল। তার কল্পনাশক্তি কবিদের মতো। টেরি আবার অন্যরকম করে কল্পনা করল। আমি নিজেও আরেকরকম করে ব্যাপারটা ভাবলাম। আমি সবসময় কল্পনা করেছি যে আমার বিজ্ঞানের জ্ঞান আছে। এবং সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের। আমি মনে করি যে, কারো নিজের ন্যূনতম অহংবোধ থাকার অধিকার আছে।
‘তোমরা ওদের সঙ্গে ঝামেলা করতে যেও না,’ আমি বললাম। ‘আমরা এখন ওদের হাতে আটকে আছি এবং দেখে শুনে ওদের নিরীহ বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করার একটা সুযোগ অন্তত আছে। অন্যদিকে আমাদের এখন ওদের দেওয়া পোশাকপরা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই।’
পোশাকগুলো একদম সাদামাটা; কিন্তু ভারি আরামদায়ক। যদিও আমরা সবাই এই পোশাকে নিজেদেরকে নাটকের সঙের মতো মনে হবে ভাবলাম।
পোশাকের মধ্যে আরো রাখা হয়েছে পুরুষের আন্ডারগার্মেন্ট। পাতলা কিন্তু মোলায়েম। সেগুলো হাঁটু থেকে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। অনেকটা পাজামার মতো।
আরো আছে অপেক্ষাকৃত পুরু স্যুট। আলমারিভরা নানাধরনের কাপড়। আছে হাঁটু পর্যন্ত সাইজের নিমা জাতীয় পোশাক, আছে লম্বা আলখাল্লা। বলাই বাহুল্য যে, আমরা নিমা জাতীয় পোশাক বেছে নিলাম।
আমরা আনন্দের সঙ্গে ¯œান সেরে পোশাক পরে নিলাম।
লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে টেরি বলল, ‘খারাপ না। ভালোই।’
আমরা শেষবার নাপিতের কাছে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। টেরির সেই কাটাচুল বেশ একটু বড়ো হয়েছে। মাথায় হ্যাট দেওয়ার ফলে ওকে মনে হচ্ছে রূপকথার রাজপুত্রের মতো। রাজপুত্রের সম্মানসূচক চিহ্নটাই শুধু নেই।
পোশাকগুলো সব একরকম। আমরা প্রথম উপরে চক্কর দেওয়ার সময় কাচের ভেতর দিয়ে যে দুজন নারীকে মাঠে কাজ করতে দেখেছি, তাদের পরনে ছিল এই পোশাক।
আমি কাঁধ স্থির করে, হাত দুটো প্রসারিত করে বললাম, ‘ওরা বুদ্ধি খাটিয়ে একটা পোশাক বের করেছে। আমি বলতে পারি, ওদের জন্য এটা খাটি পোশাক।’
দুজনই আমার কথায় সায় দিল।
‘তাহলে এখন,’ টেরি বলতে থাকল। ‘দারুণ ঘুম হয়েছে আমাদের। ঘুম থেকে উঠে আরামদায়ক একটা ¯œান হয়েছে। আমরা পোশাক পরেছি মনের মতো করে, যদিও নিজেদেরকে কিছুটা ক্লিবলিঙ্গ মনে হচ্ছে। তা তোমরা কী মনে করো, এই সভ্য নারীরা কী আমাদের সকালের নাস্তা দেবে?’
‘অবশ্যই দেবে,’ জেফ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল। ‘যদি ওরা আমাদেরকে হত্যাই করবে, তাহলে সেটা আগেই করত। আমার ধারণা ওরা আমাদেরকে অতিথি হিসাবে বিবেচনা করছে।’
‘হ্যাঁ, ত্রাণকর্তা হিসাবে প্রশংসা করতেই হয়,’ টেরি বলল।
‘হ্যাঁ, বিষয়টা কৌতূহল হিসাবে দেখা যেতে পারে,’ আমি বললাম। ‘কিন্তু সে যাই হোক, এখন আমাদের খাবার প্রয়োজন।’
আমাদের ঘরটা থেকে বাথরুমের দরোজাটাই একমাত্র আধখোলা অবস্থায় ছিল। কিন্তু এছাড়াও একটি অত্যন্ত ভারি দরোজা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ বন্ধ।
আমরা কান পাতলাম।
জেফ বলল, ‘দরোজার ওপারে কেউ আছে। টোকা দেই?’
আমরা দরোজায় টোকা দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটি খুলে গেল। দরোজার ওপাশে দেখা গেল আরো একটি বিশাল রুম। রুমের এক প্রান্তে মস্তবড় একটি টেবিল তার সঙ্গে বেঞ্চ এবং সোফা আছে। এছাড়াও ছোট ছোট টেবিল এবং চেয়ার দেখা গেল। এর সবই একেবারে খাটি, শক্ত করে বানানো। কিন্তু সাধারণ কাঠামো। অবশ্যই আরামদায়ক, আর দেখতেÑ বলার অপেক্ষা রাখে না ভারি সুন্দর। রুমের ভেতর বেশ কয়েকজন নারী। ১৮ বছরের উর্ধ্বে। এদের কারো কারো দেখে আমরা চিনতে পারলাম।
টেরি একটা নিশ্বাস ফেলে জেফের কানে কানে বলল, ‘কালকের সেই দলপতিরা!’
জেফ এগিয়ে গিয়ে মাথা নত করে ওদের ভদ্রোচিতভাবে বিনয়ের সঙ্গে সম্মান জানাল। আমরা দুজনও তাই করলাম। উত্তরে লম্বা কয়েকজন মেয়ে শিষ্টাচারের সঙ্গে আমাদের স্যালুট দিল।
আমাদের ক্ষুধার ব্যাপারে কোনো ইশারা ইঙ্গিত বা অভিনয় করতে হলো না। সামনের টেবিলেই ভরা খাবার। আমাদের ইশারায় আমন্ত্রণ জানানো হলো। টেবিলগুলো সব দুজন করে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ওরা একেকজন মুখোমুখি বসল। প্রত্যেকটা টেবিলের কাছাকাছি পাঁচজন করে অমায়িক মেয়ে নজর রাখতে থাকল।
খাবারের পরিমাণ প্রচুর না। কিন্তু পর্যাপ্ত এবং উন্নতমানের। আমরা তিনজনই ভ্রমণের ব্যাপারে অভ্যস্ত এবং নতুন যে কোনোকিছু আমাদের চমৎকৃত করে না। কিন্তু এই আয়োজন, চমৎকার খাবার, সুঘ্রাণ বাদাম, অত্যন্ত সুস্বাদু ছোট ছোট কেকÑ এগুলোর কথা বলতেই হয়। পানি পানের জন্য পানি আছে, কিছু গরম বেভারেজ আছে। কিছু পানীয় বানানো হয়েছে কোকোয়া দিয়ে।
এরপর ভালো লাগুক আর না লাগুক খাবার শেষ না হতেই আমাদের শিক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমাদের প্রত্যেকের খাবার প্লেটের পাশে বই। সত্যিকার প্রিন্ট বই। যদিও কাগজ এবং বাঁধাই আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। টাইপের ধরনও আলাদা।
টেরি বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাদের ত্রাণকর্তা! এখন আমাদের ভাষা শিখতে হবে।’
ওদের ভাষা শিক্ষা আমাদের খুব প্রয়োজন ছিল। শুধু তাই না, আমাদের ভাষাও ওদের শেখানোর দরকার ছিল।
আমাদের জন্য সমান্তরাল লাইন টানা খাতাও ছিল। আমরা যখন কোনোকিছুর নাম লিখলাম, তার সঙ্গে পাশে নিজেদের নামও লিখতে হলো।
আমরা বুঝতে পারলাম যে বইগুলো আমাদের দেওয়া হয়েছে তা স্কুলের বাচ্চাদের জন্য। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে আলোচনা। এবং আমাদেরকে পড়ানোর পদ্ধতি দেখে বুঝতে পারলাম যে, বিদেশিদের পড়ানোর আগের কোনো অভিজ্ঞতা ওদের নেই। নিজেরাও আগে কোনো বিদেশি ভাষা শেখেনি।
আরো একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করলাম। ওদের দুর্বলতা হলো, ওরা সব মেধাবীদের জন্য তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু এমন সূক্ষ্ম বোঝাপড়া, আমাদের সমস্যাগুলো তাৎক্ষণিক ধরে ফেলাÑ এসব কিছুই আমাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।
অবশ্যই আমরা আধাআধি শিখেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। ওদের কথা বোঝা এবং নিজেরা বলার জন্য আমরা যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছিলাম। আর আমরা ওদেরকে আমাদের ভাষা শেখাতে চাইনি। দরকার কী? পরের দিকে আমরা তা নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলাম। কিন্তু সেটা একবারই।
যাহোক, ওই প্রথম খাবার ছিল আমাদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। আমরা যার যার সঙ্গের ওই মেয়েদের বুঝতে চেষ্টা করেছি। জেফ আন্তরিকভাবে ওদের প্রশংসা করে যাচ্ছিল। টেরি ওর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী প্রযুক্তিনির্ভর চোখ দিয়ে বিচার করছিল। যেন সে অতীতের কোনো সিংহকে বশ করার অথবা সাপ পোষার মাস্টার। আর আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে সবকিছু পরখ করছিলাম।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, ওরা যে পাঁচজন করে আমাদের সঙ্গে রেখেছে, তারা লক্ষ্য রাখছে আমরা কোনো হুলুস্থুল বাঁধাই কিনা। আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। আমরা যদি ওদের কোনো ক্ষতি করতে চাই, ধরা যাক যে, চেয়ারগুলো আছে সেগুলোকে হাতে তুলে নিয়ে, তাহলেও তো একেকজনের বিরুদ্ধে পাঁচজন অনেক। যদিও তারা মেয়ে, তাতে কী? এটা আমাদের কাছে ভালো লাগেনি। সারাক্ষণ পাঁচজন করে সঙ্গে লেগে থাকবে সেটা কোনো স্বস্তিকর বিষয় না। যদিও পরে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা আবার রুমে একা হওয়ার পর জেফ দার্শনিকের মতো বলল, ‘নিজেরা শারীরিকভাবে আটকে থাকার বদলে বরং এটা ভালোই। ওরা আমাদেরকে বড়ো একটা রুম দিয়েছে। পালাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও আছে। আবার অনেকগুলো মেয়ের দ্বারা পাহাড়ায় থাকব। কোনো পুরুষের দেশে থাকার চেয়ে এটা ভালো।’
‘পুরুষের দেশে? তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো যে এখানে কোনো পুরুষ নেই, বোকা কোথাকার? তুমি কি জানো না যে এখানে অবশ্যই পুরুষ আছে?’ টেরি বলল।
জেফ সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত…’
‘এখনো পর্যন্ত কী? তুমি হলে একজন ভাবপ্রবণ একগুয়ে লোক। এখন পর্যন্ত কী?’
আমি বললাম, ‘ওদের হয়ত আলাদা আলাদা লেবার ডিভিশন আছে, যা সম্পর্কে আমরা এখনো কিছু শুনিনি। হয়ত পুরুষরা আলাদা কোনো শহরে থাকে। অথবা ওরা কোনোভাবে ছেলেদের পদানত করে রেখেছে, চুপ করিয়ে রেখেছে। কিন্তু অবশ্যই পুরুষ আছে।’
‘তোমাদের শেষ বক্তব্যটা খুবই সঠিক, ভ্যান। ঠিক ওরা যেমন আমাদের পদানত করে রেখেছে, চুপ করিয়ে রেখেছে। তোমার কথায় কিন্তু আমি শিউরে উঠছি।’ টেরি বলল।
আমি বললাম ‘আচ্ছা, ভেবে দেখ যে করেই হোক। আমরা প্রথম দিনে অনেক শিশু দেখেছি। এবং আমরা ওই মেয়েগুলোকে দেখেছি..’
টেরি বলল, ‘সত্যিকারের মেয়েলোক!’ টেরি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সায় দিল। ‘খুশি হলাম যে তুমি ওই মেয়েদের কথা উল্লেখ করেছি। সত্যি বলছি, যদি আমি ভাবতাম যে, ওই পাহাড়াদাররা ছাড়া আর কেউ নেই তাহলে আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম!’
আমি বললাম, ‘জানালার কথা বলছো? দেখি তো আমাদেরটা ঠিক আছে কিনা!’
আমরা জানালাগুলি দেখলাম। সহসাই সেগুলো খুলে গেল। জানালায় কোনো শিক নেই। কিন্তু বাইরে যে দৃশ্য তাতে আমাদের আশা জাগার কিছু নেই।
আমরা গতকাল যে গোলাপি দেয়ালের শহরে প্রবেশ করেছিলাম এটি সেই শহর নয়। আমাদের এই ঘরটি অনেক উঁচুতে। একটি দুর্গের থেকে বাইরের দিকে এই কক্ষ করা হয়েছে। এটি খাড়া পাহারের ঠিক উপরে অবস্থিত। জানালা দিয়ে দেখা যায় আমাদের ঠিক নিচে বাগান। বাগান থেকে ঘ্রাণও ভেসে আসছে। কিন্তু বাগানের উঁচু ওয়াল পাহাড়ের গায়ে গিয়ে মিশেছে। ঠিক কোথায় মিশেছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। খানিক দূরের পানির কলকল শব্দে বোঝা যাচ্ছে আশপাশেই নদী আছে।
আমরা জানালা দিয়ে পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকটা দেখতে পাই। দক্ষিণ-পূর্ব দিকটায় দিগন্তজোড়া দেশটি। এদিক দিয়ে সকালের উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠেছে। কিন্তু অন্যপ্রান্তে পরিষ্কার বোঝা যায় যে পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
টেরি বলল, ‘এটি একটি নিয়মিত দুর্গ। এবং আমি তোমাদের বলতে পারি, এটি কোনো মেয়ে মানুষের বানানো নয়। এর ডানদিকটায় পুরোপুরি পাহাড়। ওরা অবশ্যই আমাদের অনেক দূরে নিয়ে এসেছে।’
আমরা দুজন টেরির কথা সায় দিলাম।
জেফ স্মরণ করিয়ে দিল, ‘আমরা কিন্তু প্রথমদিন এক ধরনের দ্রুত চলা গাড়ি দেখেছি। যদি ওদের কাছে মটর থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ওরা সত্যিই সভ্য।’
‘সভ্য হোক আর না হোক, আমাদের যে করেই হোক এখান থেকে বের হতে হবে। আমি তোমাদেরকে বলছি না যে তোমরা বিছানার চাদর পেঁচিয়ে দড়ি বানাও এবং ওই দেয়াল পার হতে চেষ্টা করো। তারপরও আমি জানি, এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় আর নেই।’
টেরির কথায় আমরা দুজনও একমত হলাম। তারপর ওই নারীদের সম্পর্কে আবার আলোচনা শুরু করলাম।
…. (চলবে)