Skip to content

৫ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বডি শেমিং

ম্যাগাজিনের মডেল, নাটক-সিনেমার নায়িকা বা এই প্রজন্মের সেলিব্রিটিদের দেখে কখনো কি আপনার মনে হয়েছে “ইশ, তাদের মতো পারফেক্ট ফিগার যদি আমারও হতো!”
যদি ভেবে থাকেন, তাহলে আপনি একা নন, এই প্রজন্মের টিনএজার থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের তরুণ তরুণীদের প্রায় সবাই ‘পারফেক্ট ফিগার’-এর অবসেশনে আক্রান্ত। 
আমাদের সমাজে এরকম একজন নারীকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যাকে ছোটবেলা থেকে কখনোই নিজের বাহ্যিক রূপ নিয়ে খোঁটা শুনতে হয়নি। যদি আপনার ওজন কম হয় তাহলে আপনাকে বলা হবে ‘তুমি এত শুকনা কেন? একটু খাওয়াদাওয়া করো বেশি করে’, যদি আপনি একটু বেশি স্বাস্থ্যের অধিকারী হন, তাহলে তারাই আপনাকে কম করে খেতে বলবে, তা নাহলে আপনাকে স্লিম হওয়ার নানান ধরনের টিপস ধরিয়ে দিবে। বডি শেমিং- এর উৎস কিন্তু এখান থেকেই।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সমাজে বডি শেমিং বিষয়টা প্রকটভাবে বিদ্যমান। বিশেষ করে আমাদের দেশের বিয়ের বাজারে একটা মেয়েকে শুধুমাত্র তার বাহ্যিক রূপ নিয়ে যে কি পরিমাণ কথা শুনতে হয় তা সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো। আমার এক আত্মীয় তার মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে কয়েক মাস আগে তাদের মেয়েকে একজন যোগ্য পাত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাদের এক পারিবারিক বন্ধুর মাধ্যমে। পাত্রপক্ষ কন্যাকে বেশ পছন্দও করে ফেলেন, অন্তত তাদের দেখে তাই মনে হয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পরে আমদের ‘যোগ্য’ পাত্র উধাও হয়ে যায় এবং মেয়ের সাথে দেখা করা এমনকি তার ফোন নম্বর পর্যন্ত ব্ল্যাক লিস্টে রেখে দেয়। মেয়েটা মানসিকভাবে প্রচ- আঘাত পায়, যে পারিবারিক বন্ধুর মাধ্যমে সম্বন্ধ এসেছিল সেও ছেলের কোনো খোঁজ দিতে পারে না। অনেক আলোচনার পর মেয়েটি ছেলের অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করে। পাত্রপক্ষ থেকে তার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করা হয় এবং তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় তার মতো মাত্রাতিরিক্ত ওজনের মেয়ের জন্য এরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল।

বডি শেমিং একটা নতুন উন্মাদনা মনে হতে পারে; কিন্তু সবাই বিশেষ করে আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় এটার শিকার হয়। আমরা অনায়াসেই মানুষের বাহ্যিক বিষয় নিয়ে সমালোচনা করি যদি তারা তথাকথিত সৌন্দর্যের কৃত্রিম শর্তাবলি পূরণ করতে না পারে। এখনও আমাদের সমাজে সৌন্দর্য ও কদর্যতাকে একজনের গায়ের রং, আকার, আকৃতি ইত্যাদি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এবং আজকের সমাজে একজন নারীকে সুন্দরীর তকমা তখনি দেওয়া হবে যখন উনি স্লিম বডি, ঘন লম্বা চুল ও মসৃণ উজ্জ্বল ত্বকের অধিকারী হবেন তা নাহলে সমাজ তাকে সুন্দর বলে স্বীকার তো করবেই না, উল্টো তাকে ক্রমাগত সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকবে।

যেভাবে  বডি শেমিং একজন নারীর আত্মবিশ্বাসে কঠোরভাবে আঘাত হানে

আপনি যতই চেষ্টা করেন না কেন আপনি সবসময়ই সমাজের জন্য একটু বেশিই চিকন, নাহলে একটু বেশিই মোটা, একটু বেশিই খাটো, নাহয় একটু বেশিই লম্বা, একটু বেশি কালো, নাহলে একটু বেশি ফর্সা। বিশেষ করে আপনি যদি একজন নারী হন, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আপনার কোনো না কোনো খুঁত তাদের সামনে ধরা পড়বেই।

বডি শেমিং
তারা কথাগুলো বলার আগে কখনোই ভেবে দেখবে না যে, সামনের তরুণীটির মানসিক বিকাশে এটা কি পরিমাণ ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তারপর পিয়ার প্রেশার তো আছেই। একটু ওজন বেশির দিকে হলে তাদের নামের পাশে যোগ হয়ে যায় নানাধরনের বিশেষণ যেমন হাতি, জলহস্তী, মোটা  আরও যে কত কি তার ইয়ত্তা নেই। যদি আপনি একটু আন্ডারওয়েট হন তাহলে আপনাকে বডি শেম করা হবে এটা বলে আপনার বডিতে কার্ভ নেই, আপনি আপনার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ পাবেন বেশি করে প্রোটিন, দুগ্ধজাত খাবার খাওয়াসহ ডায়েট ফলো করার, এই আশায় হয়ত আপনি কোনো একদিন ২-৩ কেজি ওজন বাড়াতে পারবেন।  এভাবেই একজন নারী সমাজে বেড়ে উঠতে শিখে এই ধ্যান-ধারণায় যে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য তার গুণ,  মেধা, চারিত্রিক সৌন্দর্যের সমান বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই এখনকার সমাজ বডি শেমিং-এর মাধ্যমে বর্বরতার পরিচয় দিচ্ছে।

বডি শেমিংয়ের উৎস কোথায়? 

আশ্চর্য হলেও সত্যি বডি শেমিং-এর উৎস আমাদের নিজেদের মধ্যেই। এটার প্রকাশ ঘটে তিনভাবে- 
– নিজের  সাথে অন্যের তুলনা করা। (যেমন Ñ‘আমি অমুকের তুলনায় অনেক কুৎসিত’, ‘দেখো আমার কাঁধ কত চওড়া।’ 
– অন্য একজনের শরীর নিয়ে তার সামনেই সমালোচনা করা। (যেমনÑ‘তোমার সাইজের ড্রেস মার্কেটে পাওয়া যায়?’, ‘এত খেলে তোমার জন্য কোনো সম্বন্ধ আসবে না তো’)।
– অন্য একজনের শরীর নিয়ে তার অগোচরে সমালোচনা করা। (যেমনÑ‘দেখেছ সে কেমন পোশাক পরেছে? একদমই মানাচ্ছে না।’)

কিভাবে বডি শেমিং বন্ধ করা যায়

– আত্মবিশ্বাসী হন : যেহেতু বডি শেমিং-এর উৎস আমাদের নিজেদের মধ্যেই, কাজেই নিজে আত্মবিশ্বাসী হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। যে আপনার পিছনে আপনাকে নিয়ে সমালোচনা করছে, তার নিজের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। সেজন্য সে তুলনা করে মানসিক প্রশান্তি খুঁজছে।
– নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন : নিজের সৌন্দর্য আবিষ্কার করে পজিটিভ থাকুন নিজের সম্বন্ধে। ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন আপনার এমন কিছু শারীরিক সৌন্দর্য আছে, যা শুধুমাত্র আপনার নিজের এবং অতুলনীয়। যে সৌন্দর্য আপনাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন তা গ্রহণ করতে শিখুন। যা নেই তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজেকে ছোট করবেন না।

বডি শেমিং

– বডি পজিটিভ মানুষের সাথে মিশুন : এরকম মানুষের সাথে মিশুন যারা নিজেদের  নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। তারা আপনাকে নিজেদের ভালোবাসতে শিখাবে এবং এটাও শিখাবে যে শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্যই সব নয়।
– জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখুন : কে আপনাকে কি বলল না বলল এসবের উপর তো আর জীবন থেমে থাকে না। এসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের যতœ নিন এবং জীবনটাকে উপভোগ করুন।

বডি শেমিং

– পারফেকশন বলে কিছু নেই : পারফেক্ট হবার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনি যেমন, যেখানে, যে অবস্থাতেই আছেন ঠিক সেটাই আপনার পারফেকশন। সমাজের ঠিক করে দেওয়া সৌন্দর্যের পরিসীমায় নিজেকে কখনোই আটকে রাখবেন না।
– শেয়ার করুন : কেউ আপনাকে অপমান করল আর আপনি চুপচাপ মেনে নেবেন, এটা হতেই পারে না। ব্যাপারটা যে আপনার ভাল লাগে নি এটা তাকে বুঝিয়ে বলুন। যারা আপনাকে বডি শেমিং করেছে তারা ব্যাপারটার নেগেটিভিটি বুঝতে পারবে এতে।

সবশেষে এটাই বলবে যে, বডি শেমিং এখনকার সমাজের অপরিহার্য ট্রেন্ড হলেও এটা নিয়ে সচেতনতা আমাদের নিজেদের মধ্যে থেকেই শুরু হওয়া উচিত, এবং তা এখনই, এই মুহূর্ত থেকেই।
 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ