ক্ষমা করুন, ইমাম রশিদি
ইমাম রশিদি, আপনার চরণে শতকোটি প্রণাম। কঠিন পুত্রশোকেও আপনি আপনার নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি রাজ্যের এবং দেশের এই দুরভিসন্ধিময় রাজনৈতিক আবহে আমাদের দেখিয়ে দিলেন, আমরা যদি চাই, শান্তিরক্ষা করতে পারি। শান্তির বাণী প্রচার করতে কোনও ট্যাক্স লাগে না। শান্তি রাখতে পুলিশ, প্রশাসন লাগে না। লাগে একটি সংবেদনশীল হৃদয়। কিন্তু শোকের কথা হল, এই ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের সময়ও এই দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হল। পুত্রের নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে শহরের শান্তিরক্ষার কাজ করতে হল।
কিন্তু কেন? সব সময় দেশের শান্তি বজায়ের ভার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকেই নিতে হবে কেন? কেন আপনারাই মার খাবেন আবার আপনারাই করজোড়ে শান্তিরক্ষার আবেদন করবেন? কেন আমরা হিন্দু সুবিধাভোগী সংখ্যাগুরু মানুষ এ উদ্যোগ নিতে পারলুম না? কেন হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের অহঙ্কার ছেড়ে আমরা নতজানু হয়ে স্বীকার করলুম না, সরাসরি না হলেও, আসানসোলে যা ঘটেছে তার দায় আমাদের! কেন আপনার পায়ে ধরে স্বীকার করলুম না, আমাদের, অর্থাৎ হিন্দু উচ্চ বর্ণের মানুষের মধ্যে জন্ম-জন্ম ধরে জমে থাকা বিদ্বেষের কারণেই আজ আপনাকে পুত্রহারা হতে হল, ইমাম রশিদি!
এই পর্যন্ত পড়ে প্রগতিশীল বাঙালি ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলারা হয়তো-বা চটবেন। বামপন্থী এবং নাস্তিকরা বলবেন, আমরা তো ধর্মই মানি না, আমাদের আবার দায় কী! সবিনয় জানাই, আমি উদার, প্রগতিশীল অথবা নাস্তিক, যা-ই হই না কেন, ভারতে হিন্দু উচ্চ বর্ণের পরিবারে জন্মেছি বলেই আমি ভাল স্কুলে পড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখতে পেরেছি, ভদ্রগোছের একটা চাকরি জুটিয়েছি, ছেলেপুলে নিয়ে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোই। আমার দাঙ্গার ভয় নেই। যদি-বা আমার পাড়ায় দাঙ্গা হয়ও, আমাকে বাঁচাতে রাষ্ট্র জলদি পুলিশ পাঠাবে, কারণ আমি সংখ্যাগুরু, আমার জ্যাঠতুতো দাদার মামাতো পিসের খুড়তুতো ভাই হয়তো পুলিশের বড় অফিসার, কিংবা সাংসদের আপ্তসহায়ক। আমার বাচ্চাকে স্কুলে গিয়ে কোনও দিন শুনতে হয় না— তোরা কি বাড়িতে গরু খাস? তোর বাবা দাড়ি রাখেন কেন, ফেজটুপি পরেন কেন, এই গরমে তোর মা বোরখা পরে কীভাবে থাকেন রে? বন্ধুরা কোনও দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেনি, তুই কি দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়িস নাকি? আমার সহকর্মী কোনও দিন আমাকে শুধোয়নি, আপনি কি সংখ্যালঘু কোটায় চাকরি পেলেন? আর তাই, আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, আমাদের জন্মপরিচয়ের কারণেই আপনার পুত্র হারানোর দায় আমাদের, শ্রদ্ধেয় রশিদি!
শুধুমাত্র জন্মপরিচয়ের ঘাড়ে বন্দুক রাখলে অবশ্য অন্যায় হবে। আমাদের দৈনন্দিন সামাজিকীকরণও আপনার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি, আপনারা আমাদের থেকে নিচু। আপনাদের দয়া করা যায়, কিন্তু বন্ধু করা যায় না। আমাদের স্কুলগুলোতে প্রার্থনায় কোনও দিনও মুসলমান ধর্মের কোনও প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়া হয় না, আমাদের কানে ছোটবেলা থেকে ফুসমন্তর দেওয়া হয়, আপনারা ‘পিছিয়ে থাকা’, ‘অনুন্নত’ শ্রেণির মানুষ এবং সেই অনুন্নতির জন্য আপনারাই, কেবল আপনারাই দায়ী। আপনাদের সংস্কৃতি মধ্যযুগীয়, আপনাদের শিক্ষালয়ে শুধু উগ্রপন্থী তৈরি হয়। শৈশব-কৈশোরেই আমাদের মনে ভেদাভেদের বীজ বপন হয়ে যায়। আমাদের অজ্ঞানেই আমরা আপনাদের ঘৃণা করতে শিখি। আমাদের ঘৃণার ফলেই আজ আপনি পুত্রহারা, প্রণম্য রশিদি।
আমরা এই জন্মপরিচয়ের দায়, সামাজিকীকরণের দায়, স্বীকার করি না। আমরা এ দায় শুধুমাত্র দাঙ্গাকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত নই, আমরা আপনার মতো ইসলাম ধর্মাবলম্বী শান্তির দূতকে ‘নিজেদের’ বলে চালিয়ে দিচ্ছি। কোনও দায়িত্ব পালন না করে, এখনও পর্যন্ত একটা নাগরিক শান্তিমিছিল, সভা, কিছুই না করে, আমরা আপনাকে আত্মসাৎ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। আর এটাই সব সময় আপনাদের সঙ্গে হয়। আপনারা বিদ্বেষের শিকার হন, আপনারা দাঙ্গায় পর্যুদস্ত হন, আবার আপনারাই শান্তি, সম্প্রীতি রক্ষায় উদ্যোগী হন। আপনারা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির জন্য ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’-এর মতো উদ্যোগের কথা ভাবেন, আপনারা গল্পের মাধ্যমে ইতিহাসের নিরপেক্ষ প্রচারের জন্য ‘কিস্সাওয়ালা’ কর্মসূচিও পালন করেন, আপনারাই পুত্রের মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তির আহ্বান জানান। আর আমরা হিন্দু উচ্চ বর্ণের নাগরিকরা আপনাদের এই সমস্ত উদ্যোগে নিজেদের নাম জুড়ে দিই, ইমাম রশিদি!
আমরা আপনাদের এই শান্তি-উদ্যোগগুলিকে খাটোও করি। আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবেন, আপনারা নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য এ-সব করছেন। অনেকেই ভাবেন, আপনারা ভয় পেয়েছেন, তাই এ-সবে উদ্যোগী হচ্ছেন। আপনাদের শুভবোধকে আপনাদের অবস্থানগত দুর্বলতা ভেবে আমরা অনেকেই আত্মশ্লাঘা বোধ করি। আমরা, প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হিন্দু উচ্চ বর্ণের বাঙালি বলি, এ-সব আপনাদের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। দেখতেও পাই না যে, তা-ই যদি হয়, তবে সে আত্মরক্ষা তো আমাদের হাত থেকেই আপনাদের বাঁচা। আমাদের ধর্ম এবং বর্ণের প্রতিনিধি আজকের হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত রাষ্ট্রের হাত থেকে আপনাদের বাঁচা। আমরাই তা হলে আপনাদের ভয়ের কারণ!
ইমাম রশিদি, আপনার কাছে, আপনাদের কাছে আমার ধর্ম ও বর্ণ পরিচয়ের দায় আমি স্বীকার করছি। স্বীকার করছি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আমি এবং আমার জাতভাইরা সমস্ত সুযোগ কুক্ষিগত করে রেখেছি বলেই আজ আপনারা উচ্চ শিক্ষা, উচ্চ পদ থেকে বঞ্চিত। আমরা আপনাদের হেয় করেছি, অপর করেছি। আমরা অন্তরে, সচেতনে অথবা অবচেতনে আপনাদের প্রতি বিদ্বেষ পুষে রেখেছি। আজ সেই বিদ্বেষবহ্নিই আপনাকে সন্তানহারা করেছে। আমাদের ক্ষমা করবেন। আমাদের আপনার মার্জনা থেকে বঞ্চিত করবেন না, প্রণম্য রশিদি। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা