তারেক মাসুদের ‘নারীর কথা’
১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত একদল সিনেমাপ্রেমী তরুণ প্রান্তিক মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আবহকে নতুন করে তুলে ধরার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রদর্শন করতে থাকেন ‘মুক্তির গান’। সিনেমা দেখতে দেখতে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নানা মানুষ আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করে। তারা ফিরে যায় সেই ভয়াল দিনগুলোতে। তারা তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলতে শুরু করে। এভাবেই উঠে আসে এমন বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষের গল্প যারা আজও স্বাধীনতায় তাদের অবদানের স্বীকৃতি পায়নি। সেসব অনুভূতি আর গল্প নিয়ে পরবর্তী সময়ে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন আরও দুটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘নারীর কথা’ তার একটি।
‘নারীর কথা’ শুরু হয় ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথা দিয়ে। পুরো স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা শারীরিক নিপীড়ন আর মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার মতো হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি লোকসমাজে প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নারীদের নির্যাতন, নিপীড়নের কথা প্রকাশ করেছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে স্বাধীনতা এনে দিলেও দিন শেষে চারপাশের মানুষের কাছে কোনো সমাদর পাননি। অবশেষে বেছে নিয়েছেন একাকীত্বকে। তিনি নিজেকে পরিত্যক্ত সামগ্রী মনে করে পরিত্যক্ত জিনিসকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়েছেন। ‘নারীর কথা’য় তারেক মাসুদ তার পাওয়া-না পাওয়া আর বেঁচে থাকার গল্প তার মুখ দিয়ে আমাদের জানিয়েছেন। এখানে দর্শক আবার মুক্তিযুদ্ধের বীভৎসতাকে নতুন করে উপলব্ধি করে।
স্মৃতিরেখা বিশ্বাস। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। পাকিস্তানি মিলিটারি যখন তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয় তখন তিনি ও তার পরিবার লাখো শরণার্থীর মিছিলে যোগ দেন এবং একটানা ১৩ দিনের কষ্টকর যাত্রার পর সীমান্তে পৌঁছান। তিনি তার অন্তঃসত্ত্বা মায়ের তীব্র যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করেছেন ‘নারীর কথা’য়।
৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে আদিবাসী নারীরা যে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তার বর্ণনা পাই এখানে। নারীর কথায় আরও উঠে এসেছে ফরিদপুরের কোদালিয়া গ্রামের কথা। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে ১৬ জন নারীকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে। যে নারীর কারো কারো বুকে ছিল শিশুসন্তান, কেউবা ভয়ে তসবিহ জপছিল। একটা গর্তে লুকিয়েও এরা রেহাই পায়নি।
মুক্তিসংগ্রামে যুদ্ধ করেছেন এবং শহিদ হয়েছেন অগণিত নারী। ছোটো পাইটকান্দি গ্রামে নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন সশস্ত্র হানাদার বাহিনীকে শুধুই বাঁশের বল্লম আর ঢাল হাতে নিয়ে। স্বামীকে চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে দেখে শোকে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, ইটপাটকেল নিয়ে পাকিস্তানিদের রুখতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অনেক নারী অথচ তাদের কথা কেউ জানে না, তাদের খবর কেউ রাখে না। যাদের অবদান ছাড়া স্বাধীনতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল তাদের নাম ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই অবহেলিত নারীদের কথাই তারেক মাসুদ ‘নারীর কথা’য় তুলে ধরেছেন।
তারেক মাসুদ ‘নারীর কথা’র শুরু করেন একটি অর্থবহ গানের মাধ্যমে। শিল্পী মমতাজের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই,
‘কেহ কয় না নারীর কথা, কেহ কয় না নারীর কথা
সবাই গায় পুরুষের গান
মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজ রাখেনাই কি অবদান!’
[তথ্যসংক্ষেপ: নারীর কথা, পরিচালনা: ক্যাথরিন মাসুদ ও তারেক মাসুদ, ধরন: প্রামাণ্যচিত্র, প্রযোজনা: অডিওভিশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, চিত্রনাট্য: তারেক মাসুদ, সম্পাদনা: ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রগ্রহণ: মিশুক মুনীর, সুধীর পালসানে, ক্যাথরিন মাসুদ ও সৈনিক, দৈর্ঘ্য: ২৫ মিনিট, ফরম্যাট: বেটাক্যাম এসপি, মুক্তি: ২০০০]
আজ এই মহান নির্মাতার মৃত্যুবার্ষিকী। প্রয়াণ দিবসে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
অনন্যা/এআই