বিয়ে কি নারীর সুখের নিশ্চয়তা দিতে পারে?
পরস্পরের সম্মতিতে নারী-পুরুষ সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের মাধ্যমে একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের বাস্তবায়ন করায় সবার উদ্দেশ্য থাকে। নারী-পুরুষের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষা যেমন থাকে, তেমনি থাকে পরিবার-পরিজনদের মধ্যেও। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের ধারণা-প্রগাঢ় বিশ্বাস; একজন নারীর সব সুখের মূল বিয়ে এবং সংসার।
অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা, বিয়ের মাধ্যমে নারী জীবনের পরিপূর্ণতা পায়। সেইসঙ্গে সব সুখ এসে দরজায় কড়া নাড়ে। ফলে শৈশব-কৈশোর-যৌবনকাল যেমনভাবেই বাবা-মা-ভাই-বোনের শাসনে কাটুক না কেন, বিয়ে সব সমস্যার সমাধান এক নিমিষেই করে দেয়। নারীর সব চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা-ভালোলাগার পরিপূর্ণ সমাবেশ ঘটবে নারী বিবাহিত হলে। এমনকি অনেক বাবা-মাও কন্যা শিশুর শৈশব থেকে এ ধরনের মুখোরোচক গল্পগাথা শুনিয়ে বড় করেন। কিন্তু বাস্তব বলে ভিন্ন কথা। সত্যিই কি বিয়ে নারীর জীবনে সুখের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে? সব সমস্যার নিমিষেই সমাধান করতে পারে?
বর্তমানে নারীদের হীনদশা কেটেও কাটছে না । তার কারণ নারীর মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, বিয়েই তার সব সুখের সঞ্চার করবে।
আমরা পরিবার-প্রধান সমাজে বাস করি। সমাজের নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে কেউ নই। তাই সমাজের নিয়ম মেনেই নারী-পুরুষ বিয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে বসবাস শুরু করে। একে অন্যের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ে। ফলে আচার-আচরণ, জীবনযাপন, রুচি-পছন্দ এক হওয়া চাই। কিন্তু সেক্ষেত্রে সবটা মেলা ভার। অনেক ক্ষেত্রে কিছু মেলে আর কিছু মেলে না। তবু দুজনের আপস সুন্দরমতো সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে। তবে নারী-পুরুষ বিয়েকে সুখের অন্যতম নিশ্চয়তা ভেবে বসেন। এক্ষেত্রে বিয়ে কতটা নিশ্চয়তা দেয়। যদি একে অন্যের মতো না হয় বা আগলে রাখার ক্ষমতা না থাকে সেক্ষেত্রে কি সুখ নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে? সুখ কী অন্যদের থেকে প্রাপ্ত হওয়ার কোনো বিষয়? না কি সুখী হওয়ার অন্যতম শক্তি নিজের মধ্যে সঞ্জীভূত।
নারী বা পুরুষ যেই হোন না কেন সুখ জিনিসটা সবার কাছে আকাঙ্ক্ষিত। সবাই সুখী হতে চায়। কিন্তু সুখী হওয়ার মাধ্যমটা অনেকের জানা থাকলেও সে অনুযায়ী পথ চলে না। শুধু বিয়ের মাধ্যমে কেন সুখ নিশ্চিত করতে হবে। বরং নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা-মনন, কর্মের ওপর ভরসা রেখে পথ চলা কী বুদ্ধিমানের কাজ নয়? বর্তমানে নারীদের হীনদশা কেটেও কাটছে না। তার কারণ নারীর মজ্জায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, বিয়েই তার সব সুখের সঞ্চার করবে।
যেন অন্যের দেওয়া পাহাড়সম কষ্টের সামনে নিজেকে অটুট রাখা যায়। তাই নারীদের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন করে আপন সত্তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে।
কর্মোদ্যোগী হলে নারী স্বাবলম্বী হয়। আর স্বাবলম্বী থাকা অনেকটা সুখের নিশ্চয়তা দেয়। বরং বলা চলে পুরোটাই দেয়। নিজের ওপর ভরসা করে নারীরা পথ চললে জীবনের যত সংকটই আসুক না কেন, তা রুখে দেওয়ার সক্ষমতা নারী অর্জন করে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। নারীরা অসহায়ত্বের জের ধরে, সামাজিক সাপোর্ট না পেয়ে দিনের পর দিন নিজেকে নির্যাতনের জড়বস্তু করে তোলে। কিন্তু স্বামীর সংসারে নারীরা যদি নির্যাতনের শিকার হয়, তবে আত্মনির্ভরশীল নারী অনেকাংশে সেখান থেকে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারে।
যারা শুধু স্বামী-সংসার বা পুরুষতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল এবং বিয়ে সব সুখের নিশ্চয়তা দেয়; এমন ধারণা-বিশ্বাস ধারণ করে পথ চলে; সেই নারীদের পথ দেখানো কঠিন। তবে মূল কথা হলো বিয়ে নয়, বাবা-মা নয় বা অন্য কোনো মানুষ নয়; বরং নিজের বুদ্ধি, নিজের শক্তি, সামর্থ্যের ওপর আস্থা রেখে পথ চলতে হবে। সুখের নিশ্চয়তা বিয়ে নামক সামাজিক সার্টিফিকেট দিতে পারে না। বরং সুখ দিতে পারে নিজের কর্ম। নিজের দৈহিক-মানসিক শক্তি।
নারীদের বদ্ধমূল ধরণার পরিবর্তন ঘটানো জরুরি। না হয় সমাজে গজিয়ে ওঠা নানারকম নিপীড়নের মোকাবিলা করা নারীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। শ্বশুর বাড়ি, স্বামীর অত্যাচার নিপীড়ন; সর্বোপরি সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করার জন্য নিজেকেই প্রাধান্য দিতে হবে। বিয়ের মাধ্যমে সুখের নিশ্চয়তা খোঁজার মানসিকতা থাকলে সে সুখ কখনো ধরা দেবে না। সুখ নিজের মনের বিষয়, আত্মার বিষয়। তাই সুখের চাবিকাঠি নিজের হাতেই রাখতে হবে। যেন অন্যের দেওয়া পাহাড়সম কষ্টের সামনে নিজেকে অটুট রাখা যায়। তাই নারীদের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন করে আপন সত্তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে।
অনন্যা/এসএএস