Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে গ্রামে নেই পুরুষতন্ত্রের কোনো হুঙ্কার!

বিশাল আকৃতির এই পৃথিবীজুড়ে রয়েছে কত জাতি-উপজাতি। তাদের প্রত্যেকের আবার রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আরও কত কী! পুরো বিশ্ব যখন আধুনিকতার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে, তখনো বিশ্বজুড়ে রয়েছে বহু জনগোষ্ঠী; যারা আধুনিক এই পৃথিবী থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। আজ আমরা কথা বলবো আধুনিক পৃথিবীর বাইরে রহস্যময় এক জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে। যেখানে বসবাস করে এক স্বাধীনচেতা শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী ‘কালাশ’, যেখানে নেই পুরুষতন্ত্রের কোনো বালাই।

পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিমে রয়েছে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ। সেই প্রদেশেই আছে হিন্দকুশ পর্বতশ্রেণি। যাকে গ্রিকরা বলতেন ককেশাস ইন্ডিকাস। এই হিন্দকুশ পর্বতশ্রেণীর দুর্গম এলাকাটি পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। দুর্গম এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে সক্ষম। ঘন সবুজ বন, পাহাড়ি উপত্যকা থেকে গড়িয়ে পড়া পানির ঝর্ণার শব্দ, পাখিদের কোলাহল সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের রাজ্য। এমন গোছানো প্রকৃতি দেখলে হুট করেই সবার মনে পরবে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের কথা।

এখানকার প্রকৃতির পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষদের সৌন্দর্য, তাদের ভিন্নধর্মী সংস্কৃতি সবকিছুই যেন মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। এ অঞ্চলের মানুষদের চুলের রঙ সোনালি, চোখের মনি নীল। পাকিস্তানের আর কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের চেহারা, ধর্ম, সংস্কৃতি কিছুরই মিল নেই। এমনকি এরা কথাও বলেন নিজস্ব কালাশ ভাষায়।

এরা পাকিস্তানের শাসন মানেনা। এরা নিজেদেরকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এর সৈন্যসামন্তের বংশধর মনে করেন। তারা কারও অধীনে বসবাস করতে একদমই নারাজ। তাই পাকিস্তানও তাদের স্বাধীনভাবে থাকতে দিয়েছে। আর তারাও মনের সুখে বসবাস করছে দুর্গম এই অঞ্চলটিতে। আধুনিক দুনিয়া নিয়ে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জীবিকা নির্বাহের জন্য কালাশরা পাহারের ঢালে চাষ করেন। নাচ গান আমোদ প্রমোদে ভরপুর তাদের জীবন।

কালাশদের মতে তাদের পূর্বপুরুষরা গ্রিক থেকে এসেছেন। ইতিহাসেও তার মিল রয়েছে। বলা হয়, কালাশরা মূলত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যসামন্তের বংশধর। আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানে এসে এই এলাকা জয় করেছিলেন৷ সেলুকাস নামে আলেকজান্ডার এর এক সেনাপতি কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে পাহাড়ি উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন এবং স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করেন তারা৷ কালাশরা তাদেরই বংশধর। পরে আলেকজান্ডার সৈন্যসহ গ্রিসে ফেরত চলে গেলেও এরা এখানেই রয়ে যায়। কালাশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। যদিও এ সংখ্যাটি ধীরে ধীরে অনেকটাই কমে গিয়েছে৷

এ হিসেবে এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী কালাশ। কালাশদের মূল ধর্মীয় উৎসব তিনিটি; মে মাসে হয় চিলং জোশি, শরৎকালে হয় উচাও; মধ্যশীতে হয় কাইমুস৷ পাকিস্তান ইসলাম প্রধান দেশ হলেও এ কালাশরা তাদের পৌত্তলিক সংস্কৃতি মেনে এখনো মন্দিরে প্রাচীন দেবতার পূজা করে। তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় কাইমুস নামে একটি গাছকে ঘিরে।

এখানকার নারীরাও বেশ স্বাধীনচেতা। যেমনটা শুরুতেই বলেছিলাম, পুরুষতন্ত্রের কোনো হুঙ্কার নেই কালাশ গ্রামে। এখানে নারী পুরুষের সমান অধিকার। এখানে নারীদের স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে স্বামী পরিবর্তনের ক্ষমতাও। তবে এক্ষেত্রে একটি মজার আইন রয়েছে। কেউ যদি বিবাহিত নারীকে বিয়ে করতে চায় তবে সেই নারীর বর্তমান সময়ে দেওয়া সব অর্থের দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হয় বিয়ে করতে ইচ্ছুক নতুন স্বামীকে। তবে মুসলিমরা বিয়ে করলে অর্থ পরিশোধের আইন প্রযোজ্য হয় না।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এখানে এক গ্রামের কালাশ বধূকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় অন্য গ্রামের কালাশ পুরুষ। কারণ রীতি অনুযায়ী এই গোত্রে স্ত্রী ছিনতাই করা কোনো অপরাধ নয়। এক্ষেত্রে শুধু বধূর সম্মতি থাকতে হয়। স্থানীয় ভাষায় এই প্রথাকে বলা হয় ঘোনাদস্তুর প্রথা৷

আফগান ও পাকিস্তানি পুরুষরা এই নারীদের বিয়ে করার জন্য যেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ কালাশ নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে ও ধর্মান্তরিত করে থাকে এমন অভিযোগ রয়েছে পাকিস্তানি ও আফগান পুরুষদের উপর। যদিও কালাশরা নির্ভীক যোদ্ধা জাতি কিন্তু সংখ্যায় কম হওয়ায় তারা তেমন কিছু করতে পারে না।

এ সংক্রান্ত গ্রামটির আরো একটি অদ্ভুত রীতি হলো, যখন কোনো ছেলে কিশোর বয়স থেকে যৌবনে পা রাখে, ছেলেটিকে তখন পুরো গ্রীষ্মকালের জন্য কিছু ভেড়া নিয়ে উঁচু পাহাড়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ দাহ আর কষ্ট থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে বাদুলোক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে ছেলেটিকে নিজের ইচ্ছেমত গ্রামের যেকোনো বিবাহিত, অবিবাহিত যেকোনো নারীকে পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া হয়। পছন্দ করা নারীকে নিয়ে কিশোরকে চলে যেতে হয় গ্রাম থেকে দূরবর্তী কোনো নির্জন স্থানে।

কালাশদের জীবনযাত্রার সবকিছুতেই রয়েছে রঙের ছোঁয়া। নিজেদের পোশাক তারা নিজেরাই তৈরি করেন। কালাশ পুরুষরা পরেন উলের শার্ট, প্যান্ট, টুপি।নারীরা পরেন এমব্রয়ডারি করা লম্বা কালো গাউনের মতো পোশাক। কালাশ নারীরা অনেকসময় মুখে ট্যাটুও করেন। এ অঞ্চলের নারীরা এতটাই সুন্দরী যে তা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতির মতোই যেন সুন্দর তাদের মুখগুলো। তাদের রঙিন পোশাকগুলোও তাদের দ্বিগুণ আকর্ষণীয় করে তোলে।

এ জনগোষ্ঠীটির স্বকীয় কিছু গুণাবলির কারণে কালাশ অধ্যুষিত এ এলাকাটিকে কালাশদেশও বলা হয়ে থাকে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ রিপোর্ট অনুযায়ী, এশিয়ার সঙ্গে কালাশ উপজাতির জিনগত কোনো সম্পর্ক নেই। মিল আছে শুধু পাশ্চাত্যের ইউরেশিয়ানদের সঙ্গে। এরিস্টটল ইউনিভার্সিটির ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এলিসাবেথ তার একটি গবেষণায় বলেছেন, কালাশ উপজাতির মানুষ ও প্রাচীন গ্রিকদের বৌদ্ধ ভাষার মধ্যে অস্বাভাবিক মিল রয়েছে।

এ ধরনের বহু গবেষণা থেকে মোটামুটি ধরেই নেওয়া যায় কালাশরা ইতিহাস-বিখ্যাত গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সৈন্যসামন্তের বংশধর। তবে এদের ইতিহাস যাই হোক না কেন এ অঞ্চলের চোখধাঁধানো সুন্দরী নারী, ভিন্নধর্মী সংস্কৃতি, স্বাধীনচেতা মনোভাব আর অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতির কারণে এলাকাটি সর্বদাই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রস্থল।

অনন্যা/জেএজে

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ