আধুনিক ভারতীয় শিল্পকর্মের পথিকৃৎ অমৃতা শের-গিল
১৯৩৩ সালে অমৃতার বয়স তখন উনিশ। প্যারিস সেলুন নামে এক বিখ্যাত চিত্র-প্রদর্শনীতে তাঁর ‘ইয়াং গার্লস’ চিত্রকর্মটি স্বর্ণপদক পায়। ছবিটি মূলত তাঁর ছোট বোন ইন্দিরাকে নিয়ে আঁকেন। পড়ালেখা শেষে তিনি ভারতে চলে এসেছিলেন। ইউরোপে সফল এই যাত্রা থেকে ধারণা ছিল অমৃতা ভারতেও সফলতা লাভ করবেন। পশ্চিম ভারতের অজন্তা গুহার শিল্পকর্মগুলো তাঁকে অনুপ্রেরণা দান করে। গুহায় দেখা আঁকার সাথে ইউরোপের চিত্রকর্মের মিশেলে তিনি এক ধরনের ফিউশন তৈরি করেন।
পুরুষ আঁকিয়েদের ভিড়ে সমগ্র পৃথিবীতে তিনজন নারী শিল্পীকে ফিমেল আইকন বলে মানা হয়। আমেরিকার জর্ডিয়া ও’কিফ, ম্যাক্সিকোর ফ্রিদা কাহলো এবং ভারতের অমৃতা শের-গিল। অমৃতা শের-গিলকে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার পথিকৃৎ বলা হয়। শুধু তাই নয়, ইউনাইটেড নেশনের সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁর সম্মানে অমৃতার জন্মের শতবর্ষ পূর্তিতে ২০১৩ সালে The International Year of Amrita Sher-Gil ঘোষণা করে। এমন বিরল সম্মান খুব কম মানুষই পেয়েছেন।
যে বছর রবীন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে নোবেল লাভ করেন, সেই ১৯১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি অমৃতা শের-গিল হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বুদাপেস্টে জন্মগ্রহণ করেন। মা ম্যারি অ্যান্টোইনিট গটেসম্যান অপেরায় গান গাইতেন। ম্যারি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি। অপর দিকে, বাবা উমরাও সিং শের-গিল মাজিথিয়া শিখ।
জন্ম ইউরোপে। অমৃতার শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সেই ইউরোপেই। ১৯২১ সালে বিশ্বযুদ্ধের টানাপোড়েনের ফলে তাঁর পরিবারকে উত্তর ভারতের শিমলায় স্থানান্তরিত হতে হয়। সেখানেই তিনি মাত্র আট বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেন। শিমলায় স্থানান্তরিত হওয়ার জন্যই অমৃতার মধ্যে ভারতীয় সত্ত্বা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে অমৃতার মধ্যে একটু বিদ্রোহী স্বভাব ছিল। কনভেন্ট স্কুলে পড়ার সময় নিজেকে নাস্তিক দাবি করায় স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে। এবার থেকে অমৃতার বোহেমিয়ান জীবন শুরু।
ভারতে আর্ট শেখার কোনো ভালো মাধ্যম না দেখে তিনি ষোল বছর বয়সেই প্যারিসে চলে যান। শিল্পকলা নিয়ে তাঁর লেখাপড়া চলতে থাকে। প্রথমে তিনি আকাদেনু দে লা গ্রান্দে চাউমিরে ভর্তি হন। আরো পরে একোলা দে বুঁজা আর্টসে। এই অল্প বয়সেই তিনি ব্যাপক সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
প্যারিসে থাকাকালেই পল সেজান, আমেডিও মোদেয়ানি ও পল গগ্যার দ্বারা অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পরে তাহিতিয়ান নারীর বেশ ধরে আঁকেন ‘সেলফ পোর্ট্রেট অ্যাজ অ্যা তাহিতিয়ান।’ সে-সময় ভারতে ন্যুড চিত্র খুব বেশি প্রচলিত ছিল না। তা-ও এক নারী যখন আঁকছে এমন ছবি, তখন সমালোচনা হতেই বাধ্য। তবে সমালোচনা অমৃতাকে থামাতে পারেনি। অমৃতা একের পর এক ন্যুড চিত্র এঁকে গিয়েছেন। অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ন্যুড আঁকার সময় গোপনাঙ্গ সুকৌশলে লুকিয়ে রাখতেন। তবে অমৃতা সে-দিকে খুব মনোযোগী ছিলেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ন্যুড ছবি ‘স্লিপিং ওম্যান’ আঁকেন তিনি। রাখঢাকহীন এই ন্যুড চিত্রটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
১৯৩৩ সালে অমৃতার বয়স তখন উনিশ। প্যারিস সেলুন নামে এক বিখ্যাত চিত্র-প্রদর্শনীতে তাঁর ‘ইয়াং গার্লস’ চিত্রকর্মটি স্বর্ণপদক পায়। ছবিটি মূলত তাঁর ছোট বোন ইন্দিরাকে নিয়ে আঁকেন। পড়ালেখা শেষে তিনি ভারতে চলে এসেছিলেন। ইউরোপে সফল এই যাত্রা থেকে ধারণা ছিল অমৃতা ভারতেও সফলতা লাভ করবেন। পশ্চিম ভারতের অজন্তা গুহার শিল্পকর্মগুলো তাঁকে অনুপ্রেরণা দান করে। গুহায় দেখা আঁকার সাথে ইউরোপের চিত্রকর্মের মিশেলে তিনি এক ধরনের ফিউশন তৈরি করেন। সেই সময়ে আঁকা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল ঘোষের কাজ থেকে একদমই ভিন্ন রকমের সব কাজ। অনুজ্জ্বল ভারতীয় রঙের বিপরীতে তিনি ব্যবহার করতেন উজ্জ্বল ও বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ।
অমৃতা শের-গিলকে অনেকেই সেক্স পার্ভার্ট বলতেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোনো রাখঢাক তিনি রাখতেন না। সে-জন্য বহু বিতর্কের জন্মই দিয়েছেন। ১৯৩১ সালে ইউসুফ আলী খানের সাথে তাঁর বাগদান সম্পন্ন হয়। তবে কথা ছড়িয়ে পরে শের-গিলের দূর-সম্পর্কের ভাই ভিক্টর এগানের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর অনেক সেলফ পোর্ট্রেটের জন্যই অনেকে তাঁকে ভারতের ফ্রিদা কাহলো বলে ডাকতেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বহু বিতর্কে জড়িত।
এমনিতে প্রথা-বিরোধী অমৃতা ভারতে ফিরে ১৯৩৭ সালেই দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ঘুরে বেড়ান। এখানেই তিনি ‘ভিলেজ সিন’, ‘থ্রি গার্লস’, ‘চাইল্ড ব্রাইড’, ‘ব্রাইডস টয়লেট’- এই চিত্রকর্মগুলো আঁকেন। এই চিত্রকর্মগুলোই তাঁর ভারতীয় সত্ত্বার পরিচয়।
সমাজের দায়বদ্ধতা ও প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল। নিজ জ্ঞাতি-ভাইকে বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে করেন। তাঁরা হাঙ্গেরিতে চলে গিয়েছিলেন। পরে তাঁরা আবার ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরাখপুরের সারায়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এবার মুঘল স্থাপত্যের গঠন ও রঙের ব্যবহার দেখে এবং অজন্তা গুহার চিত্রকর্মের অনুপ্রেরণায় বৈচিত্র্যময় ছবি আঁকতে থাকেন। এ-সময় তিনি মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। শারীরিক অসুস্থতাও ছিল। বায়ু পরিবর্তনের জন্যে তিনি আর তাঁর স্বামী লাহোরে চলে আসেন। একটি চিত্রপ্রদর্শনী শেষে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালেই অমৃতা মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথা-বিরোধী এই শিল্পী ঊনত্রিশ বছরের জীবনে বহু তর্কের জন্ম দিয়েছেন। জরায়ুর রক্তপাতজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে ডাক্তার এসেও তাঁর জীবনরক্ষা সম্ভব হয়নি। নিজের ওপর তাঁর ভীষণ আস্থা ছিল। আর তাঁর ছিল এক ভারতীয় সত্ত্বা, যাকে তিনি বলতেন এভাবে, ‘আমি শুধু ভারতে আঁকতে পারি। ইউরোপ পিকাসোর, ম্যাটিস এবং ব্রাকের। কিন্তু ভারত শুধু আমার।’