মহাকাব্যের নারীগণ: কুন্তী, ভাগ্যবিড়ম্বিত মায়ের ছবি
কুন্তী, মহাভারতের ভাগ্য বিড়ম্বিত এক নারী চরিত্র। তিনি কর্ণ ও পঞ্চপাণ্ডবের জননী। যদুবংশীয় রাজা শূরের কন্যা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের বোন। কুন্তীর প্রকৃত নাম পৃথা। রাজা শূর নিঃসন্তান কুন্তিভোজকে পৃথাকে দান করেন। পালক পিতার নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় কুন্তী। একদিন মহর্ষি দুর্বাসা অতিথিরূপে গৃহে এলে কুন্তী তাকে পরিচর্যার মাধ্যমে তুষ্ট করেন। প্রশান্তির পুরস্কার স্বরূপ মহর্ষি দুর্বাসা কুন্তীকে একটি বর দেন। সেই বর বলে কুন্তী যেকোনো সময় যেকোনো দেবতাকে আহ্বান করতে পারবেন। তার বরে কুন্তীর পুত্রলাভ হবে।
কৌতূহল বশে কুন্তী সূর্যকে আহ্বান করেন। তার সঙ্গে মিলনের ফলে এক পুত্র লাভ করেন। সূর্যদেবের বরে কুমারীই থেকে যান। সূর্যদেবের বরপ্রাপ্ত পুত্রই হলো কবচকুণ্ডলধারী, মহাবিক্রমশালী কর্ণ। কুন্তী কোল আলো করে আসা পুত্র যদিও দেবতার বরপ্রাপ্ত কিন্তু সমাজ তাকে কখনোই কুন্তীর পুত্ররূপে স্বীকার করবে না। কুমারী মেয়ে মা হয়েছে সেই কলঙ্ক ঢাকতেই একটি পাত্রে রেখে পুত্রকে জলে ভাসিয়ে দেন কুন্তী। সূতবংশীয় অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা কর্ণকে উদ্ধার করে। তারা ‘বসুষেণ’নাম দিয়ে কর্ণকে লালন-পালন করেন। রাধার সন্তান হওয়ায় কর্ণের আরেক নাম রাধেয়।
কর্ণকে মায়ের স্নেহমমতা-ভালোবাসা, সামাজিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে কুন্তীর জীবন যেভাবে ক্ষয় হতে থাকে, মহাভারতের শেষপর্যন্ত এই ক্ষয় কোথাও কমেনি। বরং দীর্ঘায়িত হয়েছে। সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ-মমতার অপ্রাপ্তিই কুন্তীকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের দিকে ঠেলে দেয়।
রাজা কুন্তিভোজ পালিতকন্যা কুন্তীর জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন করেন। স্বয়ংবরে কুন্তী পাণ্ডুরাজের গলায় মাল্যদান করেন। কুন্তী ও পাণ্ডুর জীবনযাত্রা শুরু না হতেই কুন্তীর জীবনে ঘটে আরও একটি অঘটন। মদ্র রাজ্যে শত্রুপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে মিত্রশক্তি হিসেবে পাণ্ডুরাজ গমন করে। সেখানে জয়লাভের পর রাজা মদ্র নিজের কন্যা মাদ্রীকে পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে। ফলে কুন্তীর স্বপ্নের যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই তার জীবনে যে অঘটন ঘটে, সেখানেও তাকে নীরব ভূমিকা পালন করতে হয়। অশ্রুবিসর্জন দিয়ে মাদ্রীকে নিজ হাতেই বরণ করে নিতে হয়। একদিকে রাজা পাণ্ডু থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে নিজের সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়ে কুন্তী দিশেহারা! রাজকন্যা হলেও কুন্তীর জীবনের এ করুণ পরিণতি সাধারণ নারীর জীবনের চিরাচরিত রূপ হয়ে দেখা দেয়। কুন্তীর দৈহিক-মানসিক ক্ষয় শুরু হয় মহাভারতের কাহিনির সূচনালগ্নেই!
কুন্তীর ভাগ্যবিড়ম্বনা আরও বেড়ে যায়, যখন পাণ্ডু দুই স্ত্রীর সঙ্গে বনে মৃগয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বনে বিচরণকালে মৈথুনরত এক মৃগদম্পতিকে শরবিদ্ধ করেন পাণ্ডু। আহত মৃগ ভূপতিত হয়ে পড়ে এবং মানবরূপ ধারণ করে। প্রকৃতার্থে মৃগটি ছিল কিমিনন্দ মুনি। পুত্র কামনায় মৃগরূপ ধারণ করে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। পাণ্ডুর শরবিদ্ধ হয়ে মুনি নিহত হন। এই সময় পাণ্ডুকে অভিশাপ দেন মুনি, ব্রহ্মহত্যার পাপ করেছে। তাই স্ত্রী সঙ্গমকালেই তার মৃত্যু হবে। মাদ্রীর অতিশয় আবদারে পাণ্ডু কর্তৃক শর নিক্ষেপের ফলে কুন্তীর কপালে আরও একটি দুর্ভাগ্যের রেখা অঙ্কিত হয়।
অভিশাপগ্রস্ত হয়ে সস্ত্রীক পাণ্ডু তপস্যারত হন। কিন্তু যজ্ঞ, বেদাধ্যায়ন ও তপস্যা করেও পাণ্ডুর পাপস্খলন হয় না। পুত্র প্রাপ্তিও ঘটে না। পাণ্ডুর এ হেন অবস্থায় কুন্তী তার দৈবপ্রাপ্তির কথা জানালে কুন্তীর ঘরে একে একে জন্ম নেয় তিন পাণ্ড।ব যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন। আর কুন্তীকে প্রদত্ত বরের সাহায্যে মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে নকুল, সহদেব নামে দুই সন্তানের জন্ম দেন। আর এই পাঁচ পাণ্ডবকে একত্রে পঞ্চপাণ্ডব বলা হয়। পাঁচ পুত্রের জন্মে কুন্তীর জীবন আলোকিত হওয়ার কথা থাকলেও তিনি মহাভারতের এমন একটি ক্ষয়প্রাপ্ত চরিত্র, যার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কখনোই শেষ হয় না। ঝড়ে সব হারিয়েও ক্লান্ত পাখির মতো নিজের ছানাগুলোকে আঁকড়ে আবারও বাসা বাঁধার চেষ্টা করেছেন সর্বত্র৷
একদিন বসন্তকালে মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সংযম হারিয়ে মাদ্রীর সঙ্গে সংগমরত অবস্থায় পূর্বের অভিশাপবলে প্রাণবিয়োগ ঘটে। পাণ্ডুর মৃত্যুতে কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই প্রাণত্যাগ করতে চাইলে মাদ্রী তার সন্তানদের ভার কুন্তীকে দিয়ে পতির সহগমন কামনায় প্রাণত্যাগ করেন। কুন্তী পাণ্ডবদের নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। যৌবনকালে স্বামীর অকাল মৃত্যু এবং পাণ্ডবদের ভার গ্রহণ করে হস্তিনাপুর গমন। কিন্তু সেখানেও কুন্তীকে সহ্য করতে হয় একের পর এক পীড়ন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন ও তাই সহোদরেরা একজোট হয়ে পাণ্ডবদের নানারকম উৎপীড়ন শুরু করে। ভীমকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে চেষ্টা করে দুর্যোধন, মামা শকুনির পরামর্শে। কারণ সিংহাসন।
হস্তিনাপুরের রাজা হিসেবে যুধিষ্ঠিরের অভিষেক স্থগিত করতে নানারকম প্রপঞ্চের সাহায্য নেয় কৌরবরা। কুন্তী এখানেও নির্বাক, অবাক। নিজের সন্তানদের পক্ষ হয়ে কোনো ভাষ্যই তার ছিল না। সন্তানের মঙ্গলে মঙ্গলবাতি জ্বালিয়ে অশ্রুপাত করাই যেন কুন্তীর একমাত্র কর্ম ও নিয়তি।
ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে দ্রোণাচার্যের কাছে পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে, রাজসভায় অস্ত্রশিক্ষার প্রদর্শনী হয়। সেখানে হঠাৎ কর্ণের আবির্ভাব ঘটে। কুন্তী মূর্ছিত হয়ে পড়েন। তার সূর্যদেব প্রাপ্ত ভাসিয়ে দেওয়া সন্তানই যে কর্ণ। মায়ের মমতায় বিগলিত হলেও তাকে চুপ করে থাকতে হয়। সন্তানের দাবি নিয়ে তখনো কর্ণের সামনে উপস্থিত হতে পারেননি কুন্তী। পাণ্ডবমাতার এই হাহাকার সন্তানহারানো প্রতিটি মায়ের ক্রন্দন। কুন্তীর জীবনে সুখের মুহূর্ত পাঠকের কাছে খুব কম ধরা দিয়েছে। বরং সুখের সঙ্গে তার বসতি হয়তো গড়েই ওঠেনি। কর্ণের আগমনে কুন্তীর মন বিচলিত হতে থাকে প্রতিনিয়ত। এরমধ্যে কর্ণ যোগ দেয় পাণ্ডবদের বিপক্ষে কৌরবদের সঙ্গে। কুন্তীর জীবনে শুরু হয় আরও অশনিসংকেত। সন্তানের সামনে গিয়ে মাতার অধিকার দাবি করতে পারেন না তিনি। আবার কর্ণের অধর্মও সহ্য হয় না।
জতুগৃহে পাণ্ডবদের সহযোগে পুড়িয়ে মারতে চেষ্টা করে দুর্যোধন। যদিও সে দুর্বুদ্ধি, বিভীষিকা থেকে পাণ্ডবরা বিদুরের পরামর্শ মতে বেঁচে যায়। কিন্তু কৌরবদের এমন নিষ্ঠুর আচরণে কুন্তী, পাণ্ডবেরা প্রতিশোধের প্রথম বীজ মনে বপন করে। এমনকি পাণ্ডবরা যখন ইন্দ্রপ্রস্থে যাত্রা করে, তখনো ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাবশত পাণ্ডবদের সঙ্গ ত্যাগ করে হস্তিনাপুরের সেবায় থেকে যেতে হয় কুন্তীকে। সন্তানদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে কুন্তীর প্রতি শুরু হয় আবার অন্যায়। কুন্তীর প্রতি এত অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাকে প্রতিবাদী করে তোলেননি। প্রতিবাদহীনভাবে গড়ে তোলার কারণ হতে পারে পাণ্ডবদের সঠিক জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া। তাদের রাজ্যে অভিষিক্ত করা। আগেই যদি ধৃতরাষ্ট্রদের বিরুদ্ধে যেতো, তবে পাণ্ডবদের প্রতি ভীষ্ম বা দ্রৌণাচার্য, বিদুর এমনকি কৃষ্ণের ভালোবাসা, সঙ্গ জুটতো না। মায়ের কাজই সন্তানের মঙ্গলার্থে নিজের সুখ-আহ্লাদকে জলাঞ্জলি দেওয়া। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন যদিও কোথাও কুন্তীকে প্রতিবাদী করে তোলেননি কিন্তু তাকে একটি সত্তায় বিশেষভাবে সফল করে তুলেছেন। সেটি হলো আবহমান জননীর চিরন্তন রূপ।
পাণ্ডবদের বনবাসকালে দ্রুপদ রাজকন্যা দ্রৌপদীকে স্বয়ংবরে জিতে ফেরে অর্জুন। কিন্তু সেখানেও কুন্তীর ভুল এবং সন্তানদের প্রতি অতিমাত্রায় ভালোবাসার ফল ভুগতে হয় দ্রৌপদীকে। কুন্তীর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই একটি না একটি ঘটনায় জড়িয়ে তাকে করে তোলা হয়েছে ভাগ্যবিড়ম্বিত।
ইন্দ্রপ্রস্থে কুন্তীর অনুপস্থিতি একদিকে কুন্তীকে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটান, অন্যদিকে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত হয়ে পাণ্ডবদের রোষ আরও বাড়ে। পাণ্ডব নিজেদের রাজ্য, নিজেদের অধিকারকে পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। দুর্যোধনের ইন্দ্রপস্থে আগমন ঘটে। অপমানিতবোধ হওয়ার ও ইন্দ্রপ্রস্থের শোভাসৌন্দর্য তাকে এতটাই বিমুগ্ধ করে যে, ইন্দ্রপ্রস্থ দখলে আনতে চায়। ফলে কুটকৌশলই তার ইন্দ্রপস্থ প্রাপ্তি এবং পাণ্ডবদের শিক্ষা দেওয়ার হাতিয়ার। চাতুরি করে পাশা খেলায় পাণ্ডবদের হারিয়ে দেয়। পরাজিত পাণ্ডবগণ প্রতিজ্ঞা অনুসারে আবারও বনবাসে গেলে বিদুরের আশ্রয়ে থাকেন কুন্তী। সন্তানের জন্য আবারও শুরু হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পুরুষ চরিত্রগুলোকে এতটা বিক্রমশালী করেছেন যে, নারী চরিত্রগুলোর যথাযথ বিকাশে মনোযোগই দেননি। কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের চরিত্র পরিবর্তনশীল। মানুষের ক্ষোভ, ক্রোধ, অভিমান, প্রতিশোধস্পৃহা থাকেই।
কিন্তু কুন্তী বারংবার নির্যাতিত হয়েও চুপ থেকেছেন। তার চরিত্র অনেকটা শীতল। মায়ের নরম পরশই যেন তার চরিত্র উপস্থাপনের সার্থকতা। মহাভারতে কুন্তী নেপথ্যে থাকলেও পাণ্ডবদের সর্বদাই পরামর্শ দিয়েছেন। কর্ণকেও নিজের পরিচয় গোপন রেখে সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধ চলাকালে কৃষ্ণকে দূত করে নিজপরিচয় তুলে ধরতে বলেন। কিন্তু কর্ণের কাছ থেকে মায়ের স্বীকৃতি কুন্তী পাননি। কিন্তু কথা অনুযায়ী তার পাঁচটি সন্তানই থাকবে এমন প্রতিজ্ঞা করে। হয় অর্জুন থাকবে নতুবা কর্ণ! কিন্তু কুন্তীর জন্য দুই দিকই চরম কষ্টের। অপবাদের ভয়ে কর্ণকে ত্যাগ করলেও কর্ণের প্রতি অপরিসীম মমত্ব সর্বদাই বিরাজমান ছিল কুন্তীর মনে।
মহাভারতের যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবদের বিজয় হয়। কিন্তু কুন্তী সেই বিজয়কেও সঠিকভাবে নিতে পারেননি কারণ উভয়সংকট। একদিকে নিজের সন্তানদের জয় অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারীর সন্তানহীন হয়ে আকাশবিদারী আর্তনাদ! দুই মিলে বনবাসে যাত্রাকেই সঠিকভেবে কুন্তী, গান্ধী, ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য ত্যাগ করে। কুন্তী মাসান্তর আহার গ্রহণ করে কঠোর তপস্যায় রত হয়। এই সময় বনমধ্যে দাবানলে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে কুন্তীরও দেহত্যাগ ঘটে। কুন্তী মহাভারতের একটি পরিপূর্ণ চরিত্র কিন্তু প্রতিবাদী নন। তাকে মাতৃরূপেই বেশি প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।
মায়ের মমতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্যায়ের যে প্রতিবাদ করতে হয় এবং রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ যে শুধু পুতুলসর্বস্ব নন, এটা তিনি দেখাননি। বরং সর্বত্র কুন্তীকে ভাগ্যের জালে জড়িয়ে দৈববলকে স্বীকার করতে বাধ্য করেছেন।
অনন্যা/জেএজে