ইসাবেল মার্টিনেজ দে পেরন: ইতিহাসের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি
নারী তার ভোটাধিকার অর্জন করে ১৯২০ সালে। এবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নারীর অভিমত দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। কিন্তু এই অধিকার এক নতুন সম্ভাবনার আশ্বাস দেয়। নারী এখন রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির কঠিন জগতে তো তা পুরোপুরি সম্ভব নয়। নারী তার ভোটাধিকার অর্জন করে ১৯২০ সালে। এবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নারীর মত দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। কিন্তু এই অধিকার এক নতুন সম্ভাবনার আশ্বাস দেয়। নারী এখন রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির কঠিন জগতে তো তা পুরোপুরি সম্ভব নয়।
সেখানে একটি রাষ্ট্রের প্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে নারী সবসময় পিছিয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর পর সমগ্র বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইসাবেল মার্টিনেজ দে পেরন। সমগ্র বিশ্ব তার দিকে তাকিয়ে। কী হবে রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ? তারই পাশাপাশি নারীর ইতিহাসে যুক্ত হয় এক নতুন অধ্যায়। সমগ্র পৃথিবীতে আগে কখনোই রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাননি কোনো নারী।
১৯৩১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের লা রিওজা প্রদেশে জন্ম ইসাবেল পেরনের। বাবা স্থানীয় এক ব্যাংকের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতেন। শৈশবেই বাবাকে হারান তিনি। এই বিপর্যস্ত সময়েই তার পরিবার বুয়ের্ন আয়ার্সে স্থানান্তরিত হন। এখানেই ইসাবেল পিয়ানো, নাচ ও ফ্রেঞ্চ শেখায় মনোযোগ দেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
স্কুলের পড়া অর্ধসমাপ্ত রেখেই তিনি নৃত্যশিল্পী হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেন। কয়েকদিনেই এক স্থানীয় লোকসংগীত দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমদিকে কয়েকটি নাইট ক্লাবে নাচলেও নিজ পরিশ্রমের মাধ্যমে বুয়ের্ন আয়ার্সের প্রধান থিয়েটারে নাচার মতো খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
হয়তো জীবন এভাবেই কেটে যেতো। কিন্তু ১৯৫৬ সালে দেখা হলো হুয়ান পেরনের সঙ্গে। দীর্ঘ দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর অবশেষে তার পতন হয়েছে। নৃত্যশিল্পীর ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে তিনি হুয়ান পেরনের ব্যক্তিগত সহকারীর কাজ নেন। পেরনের নির্বাসনের সময় একমাত্র ইসাবেলই সঙ্গ দিয়েছিলেন। মাদ্রিদেই দুজন ১৯৬১ সালে বিয়ে করেন।
হুয়ানের পক্ষে আর্জেন্টিনায় ফেরা সম্ভব নয়। তবু স্থানীয় পেরনিস্ট আন্দোলনের পেছনে তার মুখ্য ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক গণ্ডগোল এবং অস্থিরতার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেন হুয়ান। একইসময়ে ইসাবেল তার রাজনীতিবিদ্যার হাতেখড়ি নিতে শুরু করেন।
মূলত পেরনিস্ট নেতাদের সঙ্গে আঁতাত বজায় রাখাটাই ছিল তার কাজ। পরবর্তী সময়ে পেরনিস্টরা আর্জেন্টিনার ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
হুয়ান পেরন ১৯৬৯ সালের দিকে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করেন। এসময় তিনি স্ত্রীকে ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ নিয়ে সারাদেশেই নেতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু ইসাবেল হতাশ করেননি। ভগ্নস্বাস্থ্য স্বামী ক্যাম্পেইনের কাজে খুব বেশি অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। ইসাবেলই সেই কাজ করতেন।
তার এই কঠিন পরিশ্রমের জন্যেই পেরন দম্পতি ১৯৭৩ সালে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক এক মাস পরেই হুয়ান পেরন মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। তাই অফিসের অনেক কাজ ইসাবেলকেই করতে হতো। ১৯৭৪ সালের পহেলা জুলাই হুয়ান পেরন আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এবার অফিসিয়ালি ইসাবেল রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। সমগ্র বিশ্ব বিস্মিত।
কিন্তু সব অর্জনই কি আনন্দের হয়? ইসাবেলের ক্ষেত্রেও তা ছিল না। ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন কিছু না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অসম পেরনিস্ট আন্দোলন, আর্জেন্টিনায় ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতা ও জাতীয় অর্থনীতির ধস এ সব সমস্যা যেন ইসাবেলের পতনের দিকেই ধাবিত করছিল। সেটা এই অর্জনের একদম প্রথমেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
পেরনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন দেখা গিয়েছিল। পেরন ডানপন্থী পেরনিস্টদের সুবিধা দিচ্ছিলেন। এদিকে বামপন্থীরা সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অপহরণ, খুন ইত্যাদি কাজ সংগঠিত করে চলেছেন। এদিকে বাজারের অবস্থা ভালো না। অর্থনীতি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
ক্যাবিনেট ক্রাইসিস যেন ইসাবেলকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল। বিশেষত তার ব্যক্তিগত সহকারী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী হোসে লোপেজ রেগা যেন তার কাঁধের বোঝা।
রাষ্ট্রের এই বাজে হাল দেখে ইসাবেল ১৯৭৫ সালে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি নেন। কিছুদিন বিরতির পর মানসিক অবসাদ দূর করতে পারলেও ডিসেম্বরে বিমানবাহিনী একটি ক্যু করে। ১৯৭৭ পর্যন্ত নিজের মেয়াদ শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি দেখেই ভাবলেন নতুন করে নির্বাচন দেবেন। লাভ হয়নি। ১৯৭৬ সালেই রক্তপাতহীন এক ক্যু করে আর্মি।
ইসাবেলকে গৃহবন্দি করা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর তাকে কাস্টডিতে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে তাকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি স্পেনে বসবাস করেন। এরপর আর্জেন্টিনা সরকার তার ক্ষমা করে দেয়।
ইসাবেল পেরনের ব্যক্তিগত অবস্থান অবশ্যই পুরোপুরি আশ্বাসজনক নয়। ইতিহাসের সব প্রথম নায়ক হতে পারে না। ইসাবেল তার উদাহরণ। ল্যাটিন আমেরিকার ‘ডার্টি ওয়ার’-এর সব হীন কাজের সন্দেহ তার ওপর। অনেকেই মনে করেন এই ‘ডার্টি ওয়ার’ বিষয়ে তার অসংখ্য জ্ঞান আছে। কিন্তু ইসাবেল প্রতিবারই তা অস্বীকার করেছেন।
তবে ল্যাটিন আমেরিকার এই সংঘাতসংকুল পটভূমিতে রাজনীতি চর্চা করে দীর্ঘদিন ক্যাবিনেটে দায়িত্ব ধরে রাখাও চাট্টিখানি কথা নয়। ইতিহাসের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতির শেষটা সুখের নয়। তবে নারীর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
অনন্যা/এআই