নারী-স্বাধীনতা আসলেই কি সম্ভব?
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?’ কিন্তু আবহমানকাল ধরে বাঙালি নারী এই দাসত্ব বরণ করে আসছে! যুগের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পুরুষতন্ত্রের তৈরি শেকল থেকে নারী আজও মুক্ত পায়নি।
নারী-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকে। কারণ পরিবারই শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। তাই পরিবার থেকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়, তা-ই ভবিষ্যতে হয়ে ওঠে তার জীবন চলার পাথেয়। যেকোনো নারী কিংবা পুরুষ পরিবার থেকেই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবিকগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। স্বাধীন হওয়ার শিক্ষাটাও পরিবার থেকেই পায়। কিন্তু ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে পরিবারগুলো যতটা উদার, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই কঠিন! বাড়ির বাইরে বের হতে হলেও কন্যাসন্তানকে সবার অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে এত বিধিনিষেধের বালাই নেই! শৈশবে যেমন, তেমনি পরিণত বয়সের নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেও একই বিধিবিধান বহাল থাকে।
অথচ মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ দুই শ্রেণিই সমান। এরপরও একশ্রেণি যতটা শাসন-শোষণের শিকার, অন্যশ্রেণি ততটাই উন্মুক্ত। একজন নারী শিশুকাল থেকেই বাবা-মা-ভায়ের মতকে গ্রহণ করে নিজের জীবন যাপন করে, কিন্তু নিজের ভালো-মন্দ বুঝলেও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে না। অর্থাৎ পরিবার নারীকে স্বাধীন চিন্তা করার অধিকার দেয় না, তার সিদ্ধান্তও মেনে নেয় না।
স্কুলের পাঠ থেকে শুরু করে সংসার জীবন কিভাবে পরিচালনা করবে, সে বিষয়েও পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। নারীকে স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না। এ কারণে নারীও স্বাধীন চিন্তা লালন করার মতো মানসিক শক্তি পায় না। এভাবে চলতে চলতে নারী হয়ে ওঠে পরনির্ভরশীল।
নারীর জীবন বর্তমান যুগে এসেও হুমকির সম্মুখীন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজেও নারীরা প্রতি পদে বাধাপ্রাপ্ত। সমাজের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সবাই নারীর বেলায় সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল নয়। বরং নারীর যেকোনো কাজকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নারীর জীবনকে বিব্রত করে তোলে।
পরিবার-সমাজের বাইরে শিক্ষাঙ্গনেও নারীর স্বাধীন মতপ্রকাশ ও স্বাধীন পথচলা পদে পদে বাধার মুখে পড়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীর মত তেমন গ্রহণ করা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুলের গণ্ডি পেরুতেই তার মাথায় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আবার স্কুল-কলেজ পেরুলেও উচ্চশিক্ষা তার জন্য সহজ হয় না। প্রায় ক্ষেত্রেই পরিবার-সমাজ তার উচ্চশিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নারীরা পরিবার-সমাজে যেমন বাধার সম্মুখীন, তেমনি কর্মক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত। কেউ অফিসে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার হেনস্তার শিকার হন, কেউবা নারীর কর্মের পথেই বাধা দেয়। নারীরা কোথাও স্বাধীন নন, নিরাপদ নন! সবচেয়ে বেশি অবহেলিত রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে। তাদের মত-পথের গুরুত্ব পরিবার-সমাজের মতো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। এমনকি পোশাক নির্বাচনেও পুরুষের ইচ্ছার কাছে নিজের রুচি বিসর্জন দিতে বাধ্য হয় নারী।
অথচ পরিবার থেকে যদি নারীকে ভালো-মন্দ বিবেচনা করার শিক্ষা না দেওয়া হতো, তাহলে সে হয়ে উঠতো স্বাবলম্বী। সিদ্ধান্তগ্রহণে সাহসী ও বিচক্ষণ। কারণ পরিবারই সবকিছুর ভিত্তি। তাই নারীকে স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পরিবারের দায়িত্ব বেশি। পরিবার থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান,তার কাজের মূল্যায়নের শিক্ষা দিতে হবে। তবেই নারীর স্বাধীনতা তরান্বিত হবে। পুরো জাতির উন্নয়নের স্বার্থে নারী স্বাধীনতা অনিবার্য। কিন্তু সেই অনিবার্য সত্য পুরুষতন্ত্র বারবার সুকৌশলে অস্বীকার করছে। দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই নারী। অথচ সেই নারীর স্বাধীনতা নেই, না কর্মক্ষেত্রে, না পরিবারে, না দাম্পত্য সম্পর্কে।
অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের শেকল পরিয়ে বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠী পুরুষতন্ত্রের নীচ বিধিমালা চালু রেখে জাতিকে বর্বরতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। কে না জানে, যে জাতি তার অর্ধেক জনশক্তির পায়ে দাসত্বের শেকল পরিয়ে রাখে, সেই জাতি চিরকালই চেতনার দাসত্বই করে। বাংলাদেশে যেভাবে নারীস্বাধীনতাবিরোধী পুরুষতন্ত্র তার বর্বর রূপ বারবার দেখাচ্ছে, তাতে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠছে, পরিস্থিতি এমন চললে, এই দেশে নারী স্বাধীনতা আসলেই কি সম্ভব?