কাজী নজরুল: প্রেমে-দ্রোহে
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি। বলেছেন সাম্যের কথা, মানবতার কথা। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। বাবার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম ও মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। যা পরবর্তী সময়ে তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে।
শুধু তাই নয়, শৈশব থেকেই লেটো দলের বাদক, রুটির দোকানের শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। লেটো দলেই সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এই দলের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সঙ্গে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। তবে আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে, পরে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।
সেই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন, তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনি নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে এ পর্যায়েও পড়াশোনা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেননি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন।
তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। সেখানেও তার সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি।
নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস খানমের সঙ্গে। বিয়ের আকদ সম্পন্ন হবার পরে কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে চলে যান। তিনি কুমিল্লা এসে সরাসরি বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানেই তার প্রমিলা দেবীর সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয়।
হঠাৎ করেই ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে এবং এ বছর ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অভিনয় সব কিছু দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে নিজের জায়গা তৈরি করে রেখে গেছেন, আরও বহু প্রজন্মের কাছেও তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। বাংলা সাহিত্যে প্রাণদান করেছেন যারা তাদের মধ্যে তিনি একজন৷ শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নয়, সমাজেও এনেছেন আমূল পরিবর্তন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা লাখো তরুণকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম। তার সুরে তাল মিলিয়ে সাম্যের গান গাইলে সমাজের অসঙ্গতিগুলো একদিন পৃথিবী ছেড়ে পালাক। তার সাহিত্যের আলো তাকে বাঁচিয়ে রাখুক যুগের পর যুগ জাতীয় কবির ১২৩তম জন্মবার্ষিকীতে এই প্রত্যাশা।
অনন্যা/জেএজে