Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পোলিওজয়ী উইলমা রুডলফ: এক অলিম্পিকে জিতলেন ৩ স্বর্ণপদক

ক্রীড়াবিশ্বে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা গল্প কিংবা কল্পনাকেও হার মানায়। না, ভুল বলা হলো। বলা উচিত, নাটকীয়। সেই গল্পের মাঝে আরেকটি উইলমা রুডলফের। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজেকে কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়, তার উদাহরণ হিসেবে রুডলফের নাম সবার আগে আসবে। বলা চলে, পৃথিবীকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই উইলমাকে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। তবু কিছু গল্প থাকেই যা সবাইকে অবাক করতে পারে, জানলে চোখের সামনে ভেসে উঠে কোনো চলচ্চিত্রের সেট।

উইলমা রুডলফের সমগ্র জীবন যেন অবহেলা আর অসহায়তার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ জুন, উইলমা ক্লার্ক্সভিলে জন্মগ্রহন করেন। যেমনটা ভাবা যেতে পারে, নবজাতকের জন্ম সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে আনবে, তেমন কিছুই উইলমার জন্মের সময় ছিল না। বর্ণবাদ প্রথা তখন ভয়ঙ্করভাবে আমেরিকান সমাজকে ঘিরে রেখেছে। তাই উইলমা কিংবা তার মা স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা পাননি। জন্মের সময় উইলমার ওজন মাত্র সাড়ে চার পাউন্ড। এমন দুর্বল শরীর দেখে অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল।

তবু উইলমা স্বাভাবিক জীবনের ঢঙ্গে বড় হচ্ছিল। রুডলফ জন্মের কয়েক বছরেই মামস, চিকেন পক্স, নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হন। যেহেতু হাসপাতালে স্বাভাবিক চিকিৎসার আশা নেই, সেহেতু তখন টোটকা চিকিৎসাই সম্বল। মায়ের সেবায় উইলমা কোনোমতে সুস্থ হয়ে উঠলেন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মায়ের অবদানের কথা বহুবার বলছেনে তিনি। কিন্তু একসময় আর পরিবার রুডলফের সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে পারলো না। ডাক্তারের কাছে নিতেই জানা গেলো বা পায়ে দুর্বলতা আছে উইলমার।

চার বছর বয়সে এই শিশুর পোলিও হয়েছে। ডাক্তার বললেন, উইলমা আর কোনোদিন হাঁটতে পারবেন না। অদ্ভুত ব্যাপার, উইলমা নিজে ছিলেন সংগ্রামী। কিন্তু এই সংগ্রামের সাহস তিনি কোথায় পেয়েছিলেন? বলতেই হবে, উইলমার মা’ই যেন ছিলেন সেই সাহসের একমাত্র স্থান। উইলমার মা ভালোভাবেই জানেন বর্ণবাদ প্রথার জন্যে এমনিতে তারা ভালো চিকিৎসা পান না। সম্ভবত সে কারণে তার মেয়েও বলি হতে চলেছেন। তার মেয়ে যদি কোনোদিন হাঁটতে না পারেন, তাহলে বাকি জীবন বহু কষ্টে কাটাতে হবে। তাই উন্নত চিকিৎসার খোঁজ করতেই হবে। তিনি মেয়ের আত্মবিশ্বাস ভাঙতে দেননি। নিজ প্রচেষ্টায় মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। ন্যাশভিলের ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ব্ল্যাক মেডিক্যাল কলেজে তখন পোলিও আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল।

ক্লার্ক্সভিল থেকে জায়গাটি অন্তত ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা বিবেচনা করলে এই সুযোগ যে কেউ তখন ছেড়ে দিতো। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যৎ যখন ধ্বংসের মুখে, তখন পঞ্চাশ মাইল পথ তেমন কঠিক কিছু কি? উইলমা আর তার মা সপ্তাহে অন্তত দুদিন হাসপাতালে যাতায়াত করতেন। প্রায় দুই বছর পর উইলমা মেটাল ব্রেস পরে হাঁটার সক্ষমতা ফিরে পেলেন। উইলমার প্রতিকূলতা ছিল বাইরের জগতে। কিন্তু পরিবারের সাহায্য তিনি বারবার পেয়েছিলেন। তাকে সুস্থ করার জন্যে পরিবারের সদস্যদের চেষ্টার কমতি ছিল না। আর মেটাল ব্রেসে হাঁটা অন্তত স্বাভাবিক অগ্রগতি।

অবশেষে ১২ বছর বয়সে উইলমাকে আর ক্রাচ, ব্রেস পরে হাঁটতে হচ্ছিল না। এতদিনের লড়াইয়ের ধৈর্য থেকেই উইলমা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন একজন এথলেট হবেন। প্রথমেই জুনিয়র হাই বাস্কেটবল দলে যোগ দেন। এতদিনের লড়াই শেষে শুধু জুনিয়র হাই বাস্কেটবলে খেলতে পারলেই হয়ে যেতো। উইলমার জন্যে তা যেন কোনোমতেই ক্ষুধা নিবারণে যথেষ্ট নয়।

টেনেসের স্টেট ট্র্যাক কোচ অ্যাড টেম্পলের নজর কাড়েন এই মেয়ে। আর এই সামান্য মুহূর্তই রুডলফের জীবনকে বদলে দেবে। তখন রুডলফের হাইস্কুলে একটা ট্র্যাক টিম বানানোর মতো যথেষ্ট বরাদ্দ ছিল না। কলেজেই তাকে সামার ট্র্যাক ক্যাম্পে ডাক দেওয়া হয়। এই ক্যাম্পে যাওয়ার ফলেই রুডলফ ১৯৫৬ অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড টিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। এমন সাফল্য সবাইকেই তাক লাগিয়ে দিতে যথেষ্ট।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে উইলমা, ১০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। প্রথম অলিম্পিকে তেমন চোখ ধাঁধানো কোনো সাফল্য তার কাছে আসেনি। উইলমাকে স্বরূপে আসতে দেখা যাবে ঠিক ৪বছর পর। ১৯৬০ সালের সেবারের অলিম্পিক হয়েছিল রোমে। সেবার ১০০ মিটার, ২০০ মিটার এবং ৪x১০০ মিটার রিলে টিমে যোগ দিয়ে প্রতিটিতেই পদক ছিনিয়ে আনেন তিনি। এভাবেই উইলমা আমেরিকার প্রথম নারী হিসেবে এক অলিম্পিক আসরে ৩টি স্বর্ণপদক বিজয় করেন। এমন সাফল্য যে কারও মনোযোগ কাড়তে যথেষ্ট।

সাফল্য ধরা দিয়েছে, কিন্তু নিজের শেকড় তিনি । ভোলেননি। সামাজিক ইতিহাস বিবেচনায় রুডলফ যেন বারবার শেকড়ের ডাক দিচ্ছিলেন। জানালেন তার সাফল্য উদযাপনের অনুষ্ঠান যেন সবার জন্যে উন্মুক্ত থাকে। ক্লার্ক্সভিলের ইতিহাসে এই প্রথম সাদা কিংবা কালো, সবাই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারলেন।

অসাধারণ এক গল্প। কিন্তু উইলমার গল্প মাত্র একজন ব্যক্তির সাফল্য ভাবলে ভুল হবে। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এবং তাদের লড়াইয়ের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু উইলমা। নিজের সাফল্যের পেছনে আরও অনেকের সাহায্য লাগে। উইলমার এই সাফল্যের পেছনে তার মা এবং ২১ ভাই বোনের অবদান কখনোই বাদ দেওয়া যাবে না। তাই উইলমা যেন অনেক মানুষকে তুলে ধরেন। এমনকি বর্ণবাদের বিরুদ্ধেও তার অবস্থান প্রশংসনীয়। আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতিনিধি হিসেবে আজও তিনি সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ