Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পার্ল এস বাক: ছিলেন পরিত্যক্ত শিশুদের জননীও

আধুনিক সাহিত্যকে ‘বিশ্বসাহিত্য’ তালিকাভুক্ত করার মানদণ্ড নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বিশ্বসাহিত্যে কোন রচনা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, কার লেখা বিশ্বসাহিত্যে উত্তীর্ণ হবে; তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। এসব বিতর্ক উজিয়ে খুব সামান্য কয়েকজন লেখকই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সেই তালিকায় বেশ কিছু নারীকেও খুঁজে পাওয়া যায়। পার্ল এস বাক সেই মহৎ লেখকদেরই একজন।

সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির হিসাব কষতে গেলে নানা বিতর্ক আসতে শুরু করে। তবে পুলিৎজার পুরস্কার নিয়ে কাউকে তেমন অভিযোগ করতে দেখা যায় না। প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে পার্ল এস বাক এই দুটো পুরস্কারই অর্জন করেছিলেন।

বিশ্বসাহিত্যে পার্ল এস বাক এক ভিন্ন ধরনের লেখকের নাম। মানুষের গল্প বলে গেছেন অনেকেই। মানবতাবাদী লেখক হয়েছেন অনেকেই। অথচ সমগ্র বিশ্ববীক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছেন মাত্র গুটিকতেক লেখক। আর মানুষের গল্প বলার ক্ষেত্রে পার্ল এস বাক এক অবিস্মরণীয় নাম। লিখেছেন ‘দ্য গুড আর্থের’ মতো অসাধারণ উপন্যাস। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, তিনি ‘মা’ নামেও একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’য়ের আড়ালে রয়ে গেছে তার সেই বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসটি।

শুধু লেখালেখিই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি রেখে গেছেন অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। জীবনভর করে গেছেন, নারী ও শিশু অধিকার আন্দোলন। সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আশ্রয়হীন শিশুদের আশ্রয়স্থল গড়ার ক্ষেত্রে। এ রকম কাজের বিষয়গুলো বুঝতে হলেও আগে বাকের জীবনের দিকে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে। সেখান থেকেই আমরা পরিচয় পাবো একদম মাটির কাছে থাকা এক বৈশ্বিক ‘মা’-এর চিত্র। যার কিছুটা চিত্র এঁকেছেন উপন্যাসেও।

মানুষের গল্প বলার ক্ষেত্রে পার্ল এস বাক এক অবিস্মরণীয় লেখিকা

পার্ল এস বাকের জন্ম পশ্চিমা দেশে। তবে সারাজীবন তিনি প্রাচ্য, মূলত চীনে ও চীনা মানুষদের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করতেন। সচরাচর বিদেশিরা প্রাচ্যের মানুষ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই ভালোবাসেন। পার্লের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মিশনারিদের সাহচর্যে থাকার বদলে চীনাদের সঙ্গেই কাটিয়েছেন অধিকাংশ সময়। সাধারণ প্রাচ্যের মানুষদের মতোই তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘুরতে যেতেন অথবা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতেন।

লেখালেখির ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা পার্লকে অনেক সহায়তা করেছে। এমনকি নিজের মায়ের অবদানটুকুও ভোলার মতো নয়। ঘরে মায়ের কাছেই লেখাপড়া শিখেছেন ছোটবেলায়। মা তাকে প্রতি সপ্তাহে কিছু না কিছু লেখার উৎসাহ দিতেন। তখন সাংঘাই মারকারি নামে শিশুদের একটি ইংরেজি ম্যাগাজিন ছিল।

সম্ভবত ইংরেজির প্রতি তার বিরক্তি এজন্যেই আসেনি। এমনিতে খুব বেশি ইংরেজি বই পড়ার সুযোগ চীনে কম। উপনিবেশের সংকট তিনি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। বহু বছর পর তিনি এই সংকটকেই তুলে ধরেছিলেন। বলছিলেন,- ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দূরত্বের দেয়াল বাড়ার কারণ হলো সাদা চামড়ার মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহম থেকে বের হতে পারে না। আর কালো চামড়ার মানুষেরা এই অহম সহ্য করতে পারেনা।’

যাই-হোক, মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি অলিভার টুইস্ট পড়ে ফেলেন। প্রতি বছরেই চার্লস ডিকেন্সের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন। এখানে হয়তো লেখার ধরনটা তার সাদামাটা হতে পারতো। কিন্তু পার্লের সঙ্গে পরিচয় ঘটে মিস্টার কং-এর। মিস্টার কং পার্লকে কনফুসিয়াজম পড়াতেন। তার অধীনেই চীনা ইতিহাস ও সাহিত্যের বিস্তৃত জগতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে।

বাক নিজ প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন সমগ্র পৃথিবীর প্রথম দত্তক সংগঠন ‘ওয়েলকাম হাউজ এডপশন প্রোগ্রাম’

মা অবশ্য আমেরিকান সংস্কৃতির ছোঁয়া যতটুকু দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ১৯১০ সালেই পার্ল যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান উচ্চশিক্ষার জন্যে। সেখানেই চার বছর পর দর্শনে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। স্থানীয় এক কলেজেও মনোবিজ্ঞান পড়ানোর চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর মায়ের অসুস্থতার কারণে চীনে ফিরে যান। ১৯১৭ সালে জন লসিং বাককে বিয়ে করেন। ইনি মূলত একজন কৃষিবিদ মিশনারি। উত্তর চীনে তারা প্রায় পাঁচ বছর কাটান। এখানকার স্মৃতি নিয়েই তিনি লিখেন ‘দ্য গুড আর্থ’। পরবর্তী সময়ে এই বইটিই তাকে সাহিত্যে নোবেল এনে দেয়।

‘দ্য গুড আর্থ’ গুরুত্বপূর্ণ বই। কারণ এখানেই প্রাচ্য সম্পর্কে একজন পাশ্চাত্য মানুষের দৃষ্টিকোণ প্রকাশিত হয়েছে। পার্ল এস বাকও একসময় ‘মা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। একদম ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত এক মা। সাধারণ মমতাময়ী মা। পার্লের মা এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি যতটা গোর্কি পেয়েছেন। তবে পার্লের মা একদম বাস্তবনিষ্ঠ এবং পাঠকের দৃষ্টিকোণে নিরাবেগ নন। নিজের অস্তিত্ব এবং তার চারপাশের মমতাকেও সমানভাবে ধারণ করেন এই মা।

এই বাস্তব দৃষ্টিকোণের সঙ্গে পার্লের জীবনের ঘনিষ্ঠতা এড়ানো সম্ভব নয়। ১৯২০ সালে পার্লের একটি সন্তান হয়। খুব আদর করে মেয়েটির নাম রাখেন ক্যারল। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই পার্ল লক্ষ করলেন ক্যারলের বৃদ্ধি ঠিক স্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে স্বামী বা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে লাভ হয়নি। তখনো ফেনিলকেটোনিয়া সিনড্রোম নিয়ে কেউ কিছু জানতে পারেনি। মূলত ক্রমশ মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার এই সমস্যা শিশুদের ভোগায়।

পার্লস এস বাকের ‘গুড আর্থ’ শুধু পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন বলেই গুরুত্বপূর্ণ নন। তিনি পাঠকদেরও ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিলেন

১৯২৯ সালে ক্যারলকে ভাইনল্যান্ডে এক ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন বাক। সেখানেই ক্যারল তার সারাজীবন কাটিয়ে দেনে। এই ঘটনা পার্লকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। তিনি ‘দ্য চাইল্ড হু নেভার গ্রিউ’ বইটিতে তার অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন। সেই সময়ে বহু বাবা মা এই বইটি পড়ে সচেতন হতে শুরু করেছিলেন।

১৯২৫ সালেই পার্লস তার পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। সেখানে মাস্টার্স করতেই গিয়েছিলেন। চীনে ফিরে যাওয়ার সময় জ্যানিস নামে এক মেয়ে শিশুকে দত্তক নেন। নিজের জীবন থেকেই তিনি গৃহহীন শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠেন।

পার্লস এস বাকের ‘গুড আর্থ’ শুধু পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল বলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি পাঠকদেরও ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিলেন। টানা ২১ মাস বেস্টসেলার লিস্টে ছিলেন। ১৯৩৪ সালেই চীনের ন্যাশনালিস্ট ও কমিউনিস্টদের ঝামেলা দেখে আমেরিকায় ফিরে যান তিনি।

এই সময়ী রিচার্ড ওয়ালসের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। রিচার্ড নিজেও গৃহহীন শিশুদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অন্যদিকে লসিং বাক নিজের মেয়ের সমস্যা নিয়েই মাথা ঘামাতেন না। তাই ১৯৩৫ এ তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। পার্লস পেনসিলভানিয়ায় গ্রিন হিল ফার্ম কিনে নেন। সেখানে রিচার্ডের সঙ্গে মিলে মোট চৌদ্দ শিশুকে দত্তক নিয়ে প্রতিপালন করেন। একেকজন একেক দেশের নাগরিক। গৃহহীন তাই একই ছাদের নিচে।

মৃত্যুর আগে তার একমাত্র ইচ্ছে ছিল গ্রিন হিল ফার্মেই যেন তাকে সমাধিস্থ করা হয়

এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। নিজের লেখায় মানবতার গল্প বলেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক নিয়েও তিনি ভাবতেন। এমনকি বর্ণবাদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। ওই সময় আমেরিকায় প্রচুর বাচ্চাকে পরিত্যাগ করে চলে যেতেন বাবা-মা। তাদের সমস্যার কথা তিনি বুঝেছিলেন। নিজ প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন সমগ্র পৃথিবীর প্রথম দত্তক সংগঠন, ‘ওয়েলকাম হাউজ এডপশন প্রোগ্রাম’। যা এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

অসহায় শিশুদের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে তিনি ‘পার্ল এস বাক ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলেন; যা এখন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে। এই ব্যস্ত ও দরদি নারী ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৩ সালের ৬ মার্চ আশি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার একমাত্র ইচ্ছে ছিল গ্রিন হিল ফার্মেই যেন তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল। এতটা মমতা দিয়ে ঘেরা ঘর কি ‘মা’ ফেলে যেতে পারেন?

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ