Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জানকী অম্মল: ভারতের প্রথম নারী উদ্ভিদ বিজ্ঞানী

বর্ণ, গোত্র ও লিঙ্গ। বিশ শতকের শুরুর দিকে মাদ্রাজে একজন ব্যক্তির সমাজে প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে তার সম্পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে এই তিনের সুবিধা বেশি পেতে হতো। এই তিনের বাইরে জন্ম নেওয়া মানেই নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া। দুর্ভাগ্যবশত ১৮৯৭ সালে মাদ্রাজেই এক নারীর জন্ম হয়, যার জীবনে এই তিনটি প্রভাবকই প্রতিষ্ঠার পক্ষে অনুকূল ছিল না। নিম্নবর্ণের পরিবার, সংকর গোত্র এবং সবশেষে তার পরিচয় ‘এক নারী’। সে তো প্রায় অনেকের ক্ষেত্রেই সত্য, তাই না? তাহলে এ নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে?

কারণ এত বাধাবিপত্তির পরও এই নারী সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নিজ যোগ্যতায় হয়ে ওঠেন উনিশ শতকের ভারতের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী৷ সমগ্র পৃথিবীতেই তাকে ভারতের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রধান স্বর এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলে চেনে৷ বলছি জানকী অম্মলের কথা। ভারতের প্রথম নারী উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত তিনি। এই নারী ভারতের ইতিহাসে একইসঙ্গে মেধা ও দৃঢ় মনোভাবের প্রতীক হিসেবে বহু নারীকেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

জানকী অম্মলের জীবনের এমন কোনো অংশ নেই, যা জানলে মানুষ অবাক হবে না। কেরালা রাজ্যেরই তেলিচেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা এ কে কৃষ্ণা পেশাগত জীবনে একজন অরনিথলজিস্ট ও সাব জজ। দুই বিয়ে করেছেন। দুই পরিবারে মোট উনিশ সন্তানের মধ্যে জানকী দশম৷ জানকীর মা শ্রীমতী দেবকির বাবা জেসি হ্যানিংটন একজন ব্রিটিশ অফিশিয়াল ছিলেন। সুযোগ ছিল ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার। তবে অম্মলের মা নিজ মা থেকে আলাদা হতে রাজি হননি।

অসমবর্ণ পরিবারের সন্তান হওয়ায় জানকী সামাজিকভাবে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন বারবার। তখন সমাজে নারীর নিয়তি একটিই৷ ভালো ঘরের বউ হওয়া। অম্মলের অন্যান্য বোনের ভালো ঘরেই বিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তবে তা অম্মলের চোখে ভালো কিছু ছিল না। এজন্য লেখাপড়ায় তিনি মনোনিবেশ করেন। সম্ভবত নিজ গোত্রের জটিলতার জন্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও সহজ হয়ে ওঠে। অম্মলের থিয়া গোত্রটিকে ভারত সরকার OBC বা অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। থিয়া গোত্র শিক্ষা কিংবা সামাজিক অবস্থানে বেশ পিছিয়ে ছিল।

যেহেতু তার গোত্র পিছিয়ে আছে, তাই জানকীকে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা খুঁজতে হয়েছিল, যা তার প্রতিষ্ঠার পথে কোনো জটিলতার দেয়াল নির্মাণ করবে না। ভাগ্য ভালো ওই সময় কেরালায় একটি খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল ছিল৷ মিশনারি স্কুলের সহায়তায় জানকী লেখাপড়া করেন। পরবর্তী সময়ে মাদ্রাজে গিয়ে কুইনস মেরি কলেজে ভর্তি হন। কুইন্স ম্যারি কলেজে লেখাপড়া শেষে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে লেখাপড়া করেন। তার দুই বছর পর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে যেকোনো নারীর জন্যে সুন্দর শিক্ষাগত জীবন। পথটাও সহজ না বলাই বাহুল্য৷ জানকীর ক্ষেত্রেও তাই। ওই সময় সমগ্র ভারতে মাত্র এক হাজারের মতো নারী পোস্ট-সেকেন্ডারি শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছিল। তবে যাত্রা এখানে থেমে গেলেও হয়তো সফল নারীদের তালিকায় তাকে যুক্ত করা যায়। কিন্তু তাতে গল্প পূর্ণতা পায় না। কারণ এরপরেও তার শিক্ষা-জীবন আরও এগিয়ে যাবে৷

এক্ষেত্রে সুযোগকেও কিছুটা এগিয়ে রাখতে হবে। ১৮৯০ সালে রেগেন লেভি বেলফোর মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতে ঘুরতে আসেন। এখানে নারীদের ম্যাডিকেলে দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন৷ তাই নিজ দেশে ফিরেই নারীদের জন্যে একটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেন। ১৯১৪ থেকে এই স্কলারশিপ চালু হয়। অম্মল নিজেও এই স্কলারশিপ পান ১৯২৪ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান।

মিশিগানেই ১৯২৬ সালে তিনি দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩১ সালেই তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এবার তিনি তার আকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রে কাজ শুরু করেন। মূলত ইন্টারস্পেসিফিক এবং ইন্টারজেনেরিক হাইব্রিড উদ্ভিদ জন্মের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন গণ ও প্রজাতির মধ্যে সংকরায়ন ঘটানোর চেষ্টা করেন।

মাঝে এক বছর জন ইনস ইন্সটিটিউটে কাজ করছিলেন। সেসময় ডারলিংটন ক্রোমোজমের গঠন নিয়ে কাজ করছিলেন। ডারলিংটন অসম্ভব মেধাবী হলেও তার চরিত্র ছিল নাজুক। অনেক সহকর্মী বা ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অম্মলের সঙ্গেও তার এমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে ১৯৩৫ সালেই সব চুকেবুকে যায়৷

ইনস এ যাওয়ার আগে অম্মলের নতুন কিছু ভাবার মতো মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। তবে সেখানেই তিনি আস্তে আস্তে বিবর্তন ও জিনবিদ্যা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। বিশেষত উদ্ভিদের নতুন প্রজাতির পলিপ্লোইডির অবদান নিয়ে গবেষণার উদ্দীপনা পান। পলিপ্লোইড আদপে কী? মূলত উদ্ভিদ কোষের নিউক্লিয়াসে একই ক্রোমোজোম অন্তত দুটো থাকে। সচরাচর অধিক সন্তান উৎপাদনে সক্ষম প্রাণীদের দুটো থাকে। একটি বাবা থেকে পায় আরেকটি মা থেকে। কিন্তু উদ্ভিদ দুইয়ের বেশি নিয়েও বাঁচতে পারে।

অম্মল কইম্বাটোরে আখ প্রজনন কেন্দ্রে কাজ করার সময় এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। মূলত পলিপ্লোইড উদ্ভিদের সুস্বাস্থ্য এবং বিবর্তনে কেমন অবদান রাখে তা বুঝতে চাচ্ছিলেন। এভাবেই তিনি উন্নত প্রজাতির এক আখ উদ্ভাবন করেন, যা ভারতের আবহাওয়ায় উপযুক্ত ফলন দিতে সক্ষম। এভাবেই ভারতে আখের উৎপাদন বৃদ্ধির পথ সুগম হয়। তাতে লাভ কী? ভারত চিনির জন্যে ইন্দোনেশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতো। অন্তত সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইংল্যান্ডেই ইনস ইনস্টিটিউটে কাজ করছিলেন। এ সময় বোটানিস্টদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি রেফারেন্স বই লিখেন যেখানে এক হাজারের বেশি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের ক্রোমোজোম এর গঠন আলোচনা করা হয়েছে।

ভারতে তখনো তার অনেক কাজ বাকি। ১৯৪৮ সালেই নেহরুর সাথে বিমানে দেখা হওয়ার পর তাকে কেন্দ্রীয় বোটানিক্যাল ল্যাবর‍্যাটরিতে পরিচালক হওয়ার প্রস্তাব আসে। দেশের কৃষিখাতে বিপ্লব আনাই উদ্দেশ্য।

নিজের কর্মক্ষেত্রে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের কড়া নজরদারি ছিলই। শুধু নারী হওয়ায় এই অবহেলা। তবু, তিনি দেশের জন্যে কাজ করেছেন। পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে এথনোবোটানি নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছেন।

১৯৭৭ সালেই নিজ কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ লাভ করেন পদ্মভূষণ উপাধি৷ মাত্র খুদে একটি জায়গা থেকে তার উত্থান। ভারতের কৃষিখাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। আর নিজের অদম্য সাহস আর পরিশ্রমের জন্যেও বিজ্ঞান জগতে এই নারী এক অনন্য হয়ে আছেন।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ