Skip to content

চর কুকরি মুকরি ভ্রমণ

চর কুকরি মুকরি ভ্রমণ

পাহাড়ে বেশকয়েক বার গিয়েছি বন্ধুদের সাথে কিন্তু দ্বীপে বা চরে কখনো ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাই এবার আমাদের গন্তব্য ঠিক হল চর কুকরি মুকরি। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। সন্ধ্যা ৭:৪৫। এম ভি ফারহান ৬ লঞ্চে যাত্রা শুরু করলাম ঢাকার সদরঘাট থেকে। গন্তব্য হল দ্বীপজেলা ভোলার বেতুয়া। লঞ্চে যেতে দেরি করেছি, এজন্য আর লঞ্চের ভেতর জায়গা পাইনি। বাধ্য হয়েই লঞ্চের ছাদে চড়তে হল।

বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে লঞ্চ সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতের মিটমিটে আলোয় নদীপাড়ের ব্যস্ত দৃশ্য দেখতে দেখতে ঢাকা পার হয়ে গেলাম। রাত বাড়ছে, সাথে শীতের প্রকোপও। কিছুক্ষণ পর লঞ্চের উপর চাদর বিছিয়ে বসলাম। সবাই মিলে গল্প, তাসখেলা, খাওয়া-দাওয়া করতে করতে অর্ধেক রাত পার করে দিলাম। ততক্ষণে চারপাশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছিল ইঞ্জিনের একটানা ঘটঘট শব্দ। লঞ্চের লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে লঞ্চের ছাদেই শুয়ে পড়লাম। চোখের সামনে শুধু রাতের অন্ধকার আকাশ আর গুটিকয়েক তারা। চোখে নেমে আসল রাজ্যের ঘুম। লঞ্চ ছুটে চলছে বিরতিহীন।

সকাল ৯টার দিকে বেতুয়া পৌঁছে গেলাম। ঢাকা থেকে বেতুয়া যেতে লঞ্চে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। লঞ্চ থেকে নেমে অটোবাইকে রওনা হলাম চরফ্যাশন বাজারের দিকে। দ্বীপ এলাকা হলেও চরফ্যাশন বেশ উন্নত। বাজারে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল “জ্যাকব টাওয়ার”। সকালের নাস্তা সেরে বাসে চড়ে রওনা দিলাম দক্ষিন আইচা বাজার। দক্ষিন আইচা থেকে অটোবাইকে চলে গেলাম কচ্ছপিয়া ঘাট। সেখান থেকেই লঞ্চে চড়ে চলে গেলাম আমাদের সেই কাঙ্খিত চর কুকরি মুকরি। লোকাল লঞ্চ যায় চর কুকরি মুকরিতে। আমরা দেরি করেছি বিধায় ট্রলার ভাড়া করে যেতে হল।

ট্রলার চলছে নদীর মাঝখান দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আশেপাশের গ্রাম পার হয়ে আসলাম। মাথার উপর উড়ছে অসংখ্য নামনাজানা পাখি। বিস্তৃত সবুজ প্রান্তরে চড়ে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। ঠিক যেন ডানো দুধের বিজ্ঞাপনে নিউজল্যান্ডকে যেমন দেখাতো অনেকটা সেইরকম। অবশেষে পৌঁছলাম চরে। বাবুল মাঝির বাড়িতে উঠলাম। দুপুরে আলুভর্তা, চিংড়ি ভাজি, ভাত, ডাল দিয়ে ভরপেট খেয়ে নিলাম। তারপর রওনা দিলাম নারকেলবাগান দেখার উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে একজন লোকের সাথে পরিচয় হল। তিনিই আমাদের নারকেলবাগান দেখাতে নিয়ে গেলেন।

যাওয়ার পথে পরল ঘন জঙ্গল। অসংখ্য ম্যানগ্রোভ গাছ। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে শ্বাসমূল। নারকেলবাগানে জেলেরা মাছ ধরে শুটকি বানায়। এখানে ১ কেজি চিংড়ির দাম মাত্র ৫০ টাকা। জায়গা হিসেবে নারকেলবাগানের কোন তুলনা হয়না। স্বপ্নের মতই সুন্দর। নদীর ধার ঘেষে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। অনেকটা সুন্দরবনের কটকার মত। সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসলাম কুকরি মুকরি বাজারে।

রাতে বাজার ঘুরলাম। এখানকার মানুষজন অনেক সরল। সাধারণ তাদের জীবন। রাতে বাবুল মাঝির বাড়িতে থাকলাম। পরদিন ভোরে ট্রলারে করে যাত্রা শুরু করলাম সোনারচরের উদ্দেশ্যে। তখনও সূর্য ওঠে নি। হঠাৎ সূর্য উঁকি দিল। লাল রঙে রঙিন। নদীতে ভেসে যাচ্ছে জেলেদের নৌকা। শিকারি পাখিগুলো উড়ে চলেছে নৌকার পিছু পিছু। নদীতে শুশুক মুখ তুলে উঠছে কিছুক্ষণ পর পর। চর মন্তাজে যাত্রাবিরতি করলাম। নাশতা সেরে আবার সোনারচরের দিকে রওনা হলাম। সোনারচরে পৌছে গেলাম। সেখান থেকে আবার কচ্ছপিয়াঘাটের দিকে যেতে লাগলাম। যেতে যেতে নৌকায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। কচ্ছপিয়াঘাটে পৌছে হাতে সময় ছিল না। দ্রুত চর ফ্যাশন চলে গেলাম। কোন রকমে হোটেলে খেয়ে এম ভি ফারহান লঞ্চ ধরলাম।

ঠাণ্ডা আজ একটু বেশি। লঞ্চ যাচ্ছে আর ভাবছি, আমি আবারও প্রকৃতি ছেড়ে যন্ত্রের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছি। দুইটা দিনের জন্য ধোঁয়া, ধুলো, ব্যস্ততা ছেড়ে গিয়েছিলাম আকাশ, নদী, পাখি, গাছের অনেক কাছে। কিন্তু যেতে তো হবেই। জীবিকার তাগিদই আমাদের তাড়া করে বেড়ায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।