নারী কেন সরব প্রতিবাদ করে না
আবহমানকাল ধরে নারীরা অত্যাচার-অবিচারের শিকার। কালের বিবর্তনে সমাজে-রাষ্ট্রে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও নারীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান রয়ে গেছে সেই পশ্চাদপদ যুগে! নারীরা জীবনের মুক্তি খুঁজে পায় না। আর এই না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নারী তার সরব প্রতিবাদ করতেও পিছুপা হয়। কিন্তু কেন নারীরা অন্যায়ের সরব প্রতিবাদ করে না?
নারীর জীবনে কিসের অভাব, যার কারণে তারা আজও অপমান-অবিচার, শাসন-শোষণকে নীরবে সয়ে যাচ্ছে! নারীর জীবনকে পঙ্কিলতামুক্ত ও নিরাপদ করে তুলতে সরব প্রতিবাদের বিশেষ অবদান থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে নারী আজও চুপ! সামাজিকভাবেই নারীকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখা হয়, যেন নারী তার যোগ্য মূল্য, সম্মান-শ্রদ্ধা না পেলেও সরব প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়।
একজন নারী তার ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে সমাজ পুরুষের চেয়ে নারীর দিকে আঙুল তোলে বেশি। প্রায় নারীর সামান্য ত্রুটিকেই বড় করে দেখে। যেটা যুক্তি, নীতি-নৈতিকতার বাইরে। মানুষকে মানুষের পরিচয়ে যদি সমাজ গ্রহণ করে, তবে নারীর প্রতি অবিচারকে রুখে দেওয়া সম্ভব। সমাজ বৃহত্তর জগৎ। তবে, নারী সরব প্রতিবাদ করতে পারে না তার প্রধান কারণ পরিবার।
নারীর জীবনের নিরাপত্তা প্রথমত পরিবার নিশ্চিত করে। কিন্তু পরিবারও যদি সম্মান বাঁচানোর দায়ে নারীকেই দোষারোপ করে, নারীর জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। সেই পরিবারেও নারী চুপ থাকে। কারণ জীবন চলার পথে একটি কথা আছে, ‘জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই চলে না’।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার চায়, সামজিকভাবে যেন তারা হেনস্তা না হয়। ফলে নারীর প্রতি অবিচারকেও তারা মুখ বুজে সহ্য করে। এমনকি পরিবারের বাইরে ঘটে যাওয়া অত্যাচারকেও অনেক সময় নিজেদের সম্মান বাঁচাতে পরিবারের সাপোর্ট থাকে। এক্ষেত্রে নারী যদি সামান্য ফোঁস করেও ওঠে, তাকে আখ্যা দেওয়া হয় ছন্নছাড়া, বেয়াদব, অসামাজিক হিসেবে! এসব কারণে অনেক সময় নারী পরিবার হারানোর ভয়ে, পরিবারের সম্মান রক্ষায় সরব প্রতিবাদকে ‘না’ বলে। কিন্তু পরিবার সমাজ যদি নারীকে শ্রদ্ধা, সম্মান জানান তবে নারীর জীবন চেতনা, মননে ও মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটতে বাধ্য।
নারী অত্যাচারিত হলেও সরব প্রতিবাদ করে না। এর প্রধান কারণ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু ব্যক্তির অধিকার, ধর্ম, মত-পথ আলাদা হবে, এটাই স্বাভাবিক। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয়েই নারীরা দিনের পর দিন বিভিন্নভাবে অত্যাচারের শিকার হলেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে! পরিবার, সমাজের চোখে চক্ষুশূল হয়ে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতো দায় নারীও নিতে চায় না। ফলে নারী বরণ করে নেয় অমানবিক আচরণের সঙ্গ। সেখানে প্রতিবাদ দূরে থাক, নিজেকে মানিয়ে নিয়ে কিভাবে সবকিছু ঠিক রাখা যায়, সেই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয় সে।
নারীর সরব প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আরও একটি প্রতিবন্ধকতা বিদ্রূপের শিকার হওয়া। নারীরা চান না, অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে দু-চারটা বাজে মন্তব্যের শিকার হতে! কিন্তু নারীর জীবনচেতনা নারী চাইলেই পাল্টে ফেলতে পারে, সেখানে প্রতিবাদের ভাষা হতে হবে সরব। এই সরব ভাষাই নারীর জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
নারীরা দাম্পত্য জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে, সমাজে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে। যুগের হাওয়া গায়ে লাগলেও নারীর জীবন তরী ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা খুব কমই প্রাপ্ত হয়েছে। পেছনে কাজ করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্মান! কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে হলেও নারীকে মুখ খুলতে হবে। নিজের প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিতে যেমন, তেমনি তার ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে, ন্যায়বিচার পেতেও তার মানসিক শক্তি গঠন করতে হবে। এজন্য সবার আগে পরিবারগুলোকে হাতেখড়ি দিতে হবে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারীর প্রকৃত স্বরূপ জানতে নারীকেই উদ্যোগী হতে হবে। আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করলেই ধীরে ধীরে নারীর মুক্তি দিনের আলো দেখবে!
অনন্যা/জেএজে